সারাদিন অফিস করে টায়ার্ড হয়ে বাসায় ফিরে চমকে উঠলাম। আমার স্ত্রী নিহিতাকে আমার মা চুলের মুঠি ধরে বাইরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম,’কী হয়েছে মা?এসব কী করছো তুমি ওর সাথে?’মা রেগেমেগে আগুন হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,’চুপ কর হারামজাদা। বিয়ে করে আনছস একটা বিয়াইত্তা তালাক দেওয়া মাইয়া। সমাজ সেবার নাম নিয়া। আবার ফকিরের ঘরের।আমি তো আগেই জানতাম এর তালাক এমনে এমনে হয়নি।ওই ছেলের ঘরে থাকতেও বড় কোন দূর্ঘটনা ঘটাইছে। দূর্ঘটনা না ঘটাইলে তারে শুধু শুধু তালাক দিবো কেন?’আমি বিষ্মিত হয়ে গেলাম মায়ের আচরণে।কী অদ্ভুত ব্যাপার! এখানে নিহিতার তালাকের বিষয়টা আসছে কেন?আমি মার দিকে তাকালাম। এবং মাকে বললাম,’কী হয়েছে মা তা আমার কাছে খুলে বলো।নিহিতা কী এমন করলো যে তার চুল ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যাচ্ছো তুমি?’মা তখন রাগে গমগম করে বললো,’সোকেশে যে তোর এক লাখ টাকা ছিল ওই টাকা থেকে আশি হাজার টাকা নাই।এই টাকা সে চুরি করে নিয়ে তার মায়ের অপারেশন করছে।কতো বড় চোর চিন্তা কর। স্বামীর ঘর থেকে টাকা চুরি করে বাপের বাড়িতে পাঠানো! এই মেয়ে তো আমি আমার ঘরে রাখবো না।চোর ঘরে রাখলে তো দুইদিন পর সব চুরি করে নিয়ে গিয়ে আমাদের মা ছেলের হাতে লোটা কম্বল ধরিয়ে দিবে! সর্বনাশ করে ফেলবে। ভাগ্য ভালো ঠিক সময়ে ধরে ফেলছি। নাইলে সর্বনাশ হতো!’মার কথা শুনে আমি অবাক হলাম।অবাক হলেও আপাতত কিছুই প্রকাশ করলাম না। শুধু মাত্র বললাম,’নিহিতা যে টাকা চুরি করেছে তা তুমি দেখেছো?’মা বললো,’দেখতে হবে কেন?চোর কী কারোর সামনে চুরি করবে নাকি! তবে সে চুরি করেছে আমি নিশ্চিত।’আমি হাসলাম মৃদু। হেসে বললাম,’অতটা নিশ্চিত কীভাবে হয়ে গেলে তুমি এই ব্যপারে?’মা বললো,’কদিন আগেই তো ওর মুখে শুনেছি ওর মায়ের অপারেশনের জন্য আশি- পঁচাশি হাজার টাকা লাগবে। টাকার জন্য অপারেশন হচ্ছে না।ও খুব কান্নাকাটি করেছে।বলেছে,মা বোধহয় আর বাঁচবে না। অপারেশন না করালে যে বাঁচবে না তা নাকি ডাক্তার বলেছে। এখন তো এটা পানির মতো পরিষ্কার।ও-ই চুরি করেছে।’আমি তখন মাকে বললাম,’দেখো মা মিছেমিছি কাউকে সন্দেহ করা বিরাট দোষ।এটা কখনো করো না!’মা তখনও নিহিতার চুল ছাড়েনি। এবার আরো শক্ত করে ওর চুল ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো বাইরে।আর বলতে লাগলো,’ফকিরনির মেয়ে তোর মার কাছে গিয়ে মর। এইখানে আর না।আর আশি হাজার টাকা কড়ায় গন্ডায় হিসাব করে দিয়ে দিস। নয়তো পুলিশ দিয়ে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো মা মেয়ে দুইটারেই!’
আমি এবার মার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এবং জীবনে প্রথম বার মায়ের সাথে উচ্চ গলায় কথা বললাম। বললাম,’মা,ওর চুল ছাড়ো বলছি!’মা আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। কিন্তু ওর চুল ছাড়লো না।আমি নিজেই এবার এগিয়ে গিয়ে মার হাত থেকে ওর চুল ছাড়িয়ে নিলাম। তারপর মাকে বললাম,’যথেষ্ঠ হয়েছে। যথেষ্ঠ! অনেক অসম্মান করেছো। অনেক!শুনো মা,গরীব হলেই মানুষ চোর হয়ে যায় না।এই ধারণাটা পরিবর্তন করো।আর তালাকপ্রাপ্তা মেয়ে বলতেই যে নষ্টা, খারাপ এটা ভাবাও বন্ধ করো।তালাকপ্রাপ্তা মেয়ে যদি খারাপ হয় তবে তো তোমার ছোট বোন শাম্মী আন্টিও খারাপ। তাকেও তার হাসব্যান্ড তালাক দিয়েছে।কই থাকে তো কোনদিন খারাপ বলোনি!আর টাকার ব্যপারে যে বললে ও চুরি করেছে এটা একটা ভুয়া কথা।মনে যা আসে তাই বলে দিলেই হয় না।আমরা সন্দেহ করে অনেক সময় অনেক ভালো ভালো মানুষকে অপবাদ দিয়ে ফেলি। শাস্তি দেই। তাদের উপর জুলুম করি। কিন্তু আমরা জানি না যে মজলুমের দোয়া মহান আল্লাহ তায়ালা সবার আগে শোনেন এবং কবুল করেন। মনে রেখো মা, কখনো না জেনে না শোনে এমন মিথ্যে অপবাদ কাউকে দিয়ে আল্লাহকে রাগান্বিত করে ফেলো না।আর যে টাকার জন্য তুমি নিহিতাকে মারধোর করছো চোর ডেকেছো সেই টাকা নিহিতা নেয়নি।ওর মায়ের চিকিৎসা ওদের বাড়ির জমির অর্ধেকটা বিক্রি করে হয়েছে।টাকাটা আমি নিয়েছিলাম। অফিসে যাওয়ার সময় আমার এক বন্ধু হুট করে ফোন করে বললো তার আশি হাজার টাকার প্রয়োজন।আর তুমি তখন নামাজে ছিলে।চাশতের নামাজ পড়ছিলে।তাই তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারিনি।হাতে সময় কম ছিল। অফিসের টাইম হয়ে যাচ্ছিল। তাই দ্রুত সোকেশের উপর থেকে চাবি নিয়ে ড্রয়ার খুলে টাকাটা নিয়ে চলে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম অফিস থেকে ফিরে বলবো। কিন্তু ঘরে ফিরে আসার আগেই তুমি নিহিতাকে মিথ্যে দোষারোপ করে ওর উপর নির্যাতন শুরু করে দিলে!
ছিঃ মা ছিঃ!এই যে এতো এবাদত।এতো নামাজ কালাম।দান সাদকা,সিজদাহ।এসব দিয়ে তো বেহেস্তে যেতে পারবে না। যদি তুমি নির্দোষ একটি পিঁপড়াকেও আঘাত করো, তবে মনে রেখো পিঁপড়াও কষ্ট পায় কারণ তার প্রাণ আছে।যার প্রাণ আছে সেই প্রাণী। মহান আল্লাহ নির্দোষ কোন প্রাণীকে আঘাত করলে হাশরের ময়দানে এর হিসাব নিবেন। তখন এমনও হতে পারে তোমার সারা জীবনের এবাদত একটা প্রাণীকে কথায় কিংবা শারীরিক আঘাত করার পরিণামে বরবাদ হয়ে যাবে।সারা জীবন মনের ভেতর লালায়িত জান্নাতের স্বপ্নটা অপূর্ণ থেকে যাবে।’কথাগুলো বলে শেষ করে আমি নিহিতার একটা হাত ধরে তাকে ঘরে নিয়ে গেলাম। তারপর ওর মাথায়,গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,’নিহিতা, ভুল হয়ে গেছে।মা যা করেছেন তা ঠিক নয়।এটা মার অপরাধ।আমি তো মাকে অনেক কিছু বলেছি। দেখবে মা তার ভুল বুঝতে পারবেন। এবং ভবিষ্যতে আর কখনো এমন ভুল করবেন না!নিহিতা কাঁদতে লাগলো আমার কথাগুলো শুনে। কাঁদতে কাঁদতে সে বললো,’আমি এই জীবনে এর বেশি কিছু চাইনি। মানুষ বলে একজন ভালো স্বামী জান্নাতের চেয়েও বেশি প্রশান্তি দিতে পারে।হ্যা এটা সত্যি।আমি এখন জান্নাতের চেয়েও বেশি প্রশান্তি পাচ্ছি।’সে রাতেই মা এলো আমাদের ঘরে। এসে কেঁদে কেটে নিহিতার হাত ধরে বললো,’মাগো, সারা জীবন এবাদত করে এসেছি।আর ভেবে এসেছি আমি একজন পূর্ণাঙ্গ মুসলিম।আমি একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। আমার কোন ত্রুটি নাই। কিন্তু আজ আমি বুঝতে পেরেছি যে আমার ত্রুটির কোন অভাব নাই। আমার এই বৃদ্ধ বয়সে আমার ছেলে আমায় শিখিয়ে দিয়েছে।আমায় স্বতর্ক করেছে।আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি মা। তোমার হাত ধরে কথা দিচ্ছি মা, মহান আল্লাহ পাক সাক্ষী থাকুন।আমি আমার বাকী জীবনে অযথাই একটি পিঁপড়াকেও কষ্ট দিবো না!তুমি আমায় মাফ করে দেও মা!আমি লজ্জিত।আমি বড় লজ্জিত মা!’নিহিতা মার চোখের দিকে তাকালো। এবং কান্নাভেজা গলায় বললো,’আপনি যে আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন এতেই আমি খুশি। আল্লাহ আপনাকে কবুল করুন।মা জোরে জোরেই পড়লেন,’আমিন।’আর আমি তাদের দুই মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, এভাবেই বদলে যাক আমাদের সমাজ। দুদিনের দুনিয়ার ধন সম্পদের গরিমা ভুলে গিয়ে মানুষ হয়ে উঠুক আরো শুদ্ধ মানুষ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট