নিজস্ব প্রতিনিধি ঃ
আজ ঐতিহাসিক বারই রবিউল আউয়াল। আজ থেকে ১৪৯৮ বছর আগের এই দিনে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. এই পৃথিবীতে আগমণ করেন। সব নবীর সর্দার তিনি, শ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী তিনি। তিনি বলেন, আমি কাল কেয়ামতে আদম সন্তানের নেতা হব, আমার হাতেই থাকবে প্রশংসার পতাকা। [মুসলিম শরিফ]তিনি মানবজাতির জন্য সুপারিশকারী হবেন। আল্লাহর হাবিব তিনি, জিন ইনসান সবার প্রিয় পয়গম্বর তিনি। মানুষের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ যত মহৎ গুণ হতে পারে সব সুন্দর বিষয় তার মাঝে একীভূত হয়েছিল বিস্ময়করভাবে। তার সম্পর্কে তার সংস্পর্শধন্য সাহাবিরা এককথায় যে বিবরণ দিতেন তা হচ্ছে এমন, তিনি এমন এক মহান ও সুন্দরতম সত্তা, আগেও তার মতো কেউ ছিল না, তার পরেও তার মতো কাউকে দেখা যাবে না। এজন্যই তাকে ভালোবাসতে হয় হৃদয় উজাড় করে। মনের মাধুরি মিশিয়ে তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয় প্রত্যেক মুসলিমকে।বিখ্যাত সব হাদিসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল সা. বলেন, তোমাদের কেউ আমাকে স্ত্রী পরিবার সন্তান ও নিজের থেকেও অধিক ভালোবাসা ছাড়া পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না। [বুখারি, মুসলিম]এবার আমরা মূল বিষয়ে প্রবেশ করতে চাই। প্রত্যেক বছর বারই রবিউল আউয়ালে আমাদের সমাজে দেখা যায় চরম বিভক্তি। এক দল মহা ধুমধামে জশনে জুলুশ বের করেন। আরেক দল ততোধিক শক্তিতে এর বিরোধিতা করেন। এক দল বলেন, নবীজির জন্মের উৎসব করা ইমানের অংশ। এটা সব ঈদের সেরা ঈদ। অপর দল বলেন এটা একটা বিদআত। বাহ্যত মনে হয় এই দুই দলের মাঝের দূরত্ব কোনোভাবেই ঘুচবার নয়। একদল আরেক দলকে গোমরাহ বিভ্রান্ত এমনকি ইসলামের চরম দুশমন মনে করে। অথচ তলিয়ে দেখলে বিষয়টিকে এত জটিল মনে হবে না।প্রথমেই আমরা দুই পক্ষের চিন্তা তুলে ধরব, তারপর খুঁজে বের করার চেষ্টা করব মাঝামাঝি একটি সমাধানের পথ। বাংলাদেশের ধর্ম চর্চায় প্রধানত দুটি ধারা আছে। ভক্তিবাদি ও শুদ্ধতাবাদি। ভক্তিবাদি বলতে যারা সুফিবাদ চর্চা করেন। শুদ্ধতাবাদি বলতে যারা সব কিছুর ক্ষেত্রেই কুরআন সুন্নাহর মূল টেক্সট অনুসরণের দাবি করেন। এই দুইয়ের মাঝে অসংখ্য দল উপদল আছে। কিন্তু সব ধারা উপধারা শেষে এই দু ধারাতেই শেষ হয়।সুফিবাদিরাই মূলত আমাদের দেশে ঘটা করে বারই রবিউল আউয়াল উদযাপন করেন। এই উদ্যাপন কেবল আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বেই আছে। এমনকি আরব দেশগুলোতেও অনেক শাইখ মিলাদুন্নবী উদ্যাপনের ধারা বর্তমান। এর সূচনা ইরাকের আর্বিলের শাসক মালিকুল মুজাফফরের আমলে হিজরি ষষ্ট শতকের শেষ দিকে ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে।শুদ্ধতাবাদিরা এমন কোনো উৎসবকে বিদআত আখ্যা দেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, যে বিষয়টি রাসুল সা. নিজে করেননি, সাহাবিরা করেননি, ছয়শ বছর পর গিয়ে যে উদ্যাপনের সূচনা তা কখনও ইসলামের অংশ হতে পারে না। এটা স্পষ্টতই বিদাত। ইসলাম কখনও আবেগ দিয়ে চলে না। রাসুলের ভালোবাসায় আবেগে যা ইচ্ছা তা করা কোনো দিন বৈধ হতে পারে না। ইসলামকে মৌলিকত্বে ধরে রাখতে হলে অবশ্যই এ ধরনের বিষয় থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। মূলত এসব তর্কের শেষ নেই। এতে অনেক শাস্ত্রীয় জটিলতা আছে। বিদআত কাকে বলে সেটি নির্ধারণেও আছে অনেক মতামত।নতুন কিছু হলেই সেটা বিদআত হয় না। নতুন কিছু ধর্মের মাঝে সংযোজন করলে সেটি বিদাআত। সংযোজন বলা হবে কাকে সেটি নিয়েও আছে তর্ক। আর এসব যুক্তি তর্ক ও মতামত যে কোনো ধর্মের জন্য অবশ্যই সুন্দর একটি বিষয়। বিভিন্ন রকম মতামত থাকবে একেকটি বিষয় নিয়ে, থাকবে পর্যালোচনা ও আলোচনা। কেউ কারও চিন্তা মেনে নিতে বাধ্য নয়। প্রত্যেকের নিজস্ব চিন্তা ভাবনা থাকতে পারে। অবশ্য এসব মতামত দেয়ারও কিছু রুলস আছে।নীতিমালার আলোকে বিভিন্ন মতামত প্রদানের ধারা চৌদ্দশ বছর ধরে চলমান। যে কোনো সজীব মতাদর্শ ও ধর্মের এটা একটা বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মতানৈক্য যখন বিভক্তি ও কোন্দলের দিকে নিয়ে যায় তখনই বাধে গোল। এজন্য আমরা এই দুই প্রান্তিকতা থেকে মাঝের একটি পথ বের করে নেয়ার চেষ্টা করব। বিদগ্ধ আলেমরা সাতশ বছরের অধিক সময় ধরে যেটা গ্রহণ করে আসছেন, আমরাও সেই পথ গ্রহণ করব। আর সেই পথ হচ্ছে পরস্পরকে ছাড় দেয়া। যারা মিলাদুন্নবী পালন করছেন তারা বিপরীতপক্ষের কাজের ব্যাখ্যা গ্রহণ করবেন। আর যারা মিলাদুন্নবী পালন করতে অস্বীকৃত তারা মিলাদুন্নবীর পক্ষাবলম্বনের জন্য জায়গা রাখবেন।যারা নবীজির জন্মদিন পালন করছেন তারা রাসুলের ভালোবাসা থেকেই করছেন। কিন্তু যারা এটা পালন করছে না তাদের কি নবী বিদ্বেষী বলা ঠিক হবে? প্রিয় নবীর সাহাবিরা কেউ তো এই দিবস পালন করেননি, তাহলে তারা কি সবাই নবীর শত্রু ছিল? আমরা সাধারণ মুসলিমরাই নবীর আশেক হয়ে গেলাম? এভাবে শান্তভাবে চিন্তা করলে বিষয়টির সমাধান হয়ে যায়। নবীজিকে ভালোবাসার বিভিন্ন পদ্ধতি হতে পারে, আমি একটা পদ্ধতি অবলম্বন করলাম, অন্য কেউ ভিন্নভাবেও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে। প্রত্যেকে নিজস্ব একটা ভঙ্গিতে তার মনোভাব প্রকাশ করবে এটা-ই স্বাভাবিক।যারা জন্মদিন উদ্যাপন করছেন না তারা বিপরীত পক্ষের প্রতি কঠোর না হলেই হলো। আপনি করছেন না, সমস্যা নেই। কিন্তু যে এভাবে জশনে জুলুশ করে ইমানি শক্তি লাভ করে তার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সোচ্চার হওয়ার অর্থ হয় না। তার কারণ রবিউল আউয়ালের বারো তারিখে সাহাবি তাবেয়ি যুগে মিলাদের প্রচলন না হলেও পরবর্তী যুগে এর প্রচলন হয়েছে। যারা প্রচলন করেছেন তারা এর উপকারী দিকগুলো দেখেই প্রচলন করেছেন। কেবল রাসুলের যুগে ছিল না বলে কোনো কিছুকে সরাসরি বিদাআত বলে দেয়া যায় না। বর্তমানের অনেক কিছুই রাসুলের সা. যুগে ছিল না। মাদ্রাসার বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি তখন ছিল না। নামাজের পর হাত তুলে দোয়া করার প্রচলন রাসুলের যুগে ছিল না। যারা মিলাদুন্নবী উদ্যাপন বিরোধিতা করেন তাদেরই অনেকেই আবার হাত তুলে দোয়া করার পক্ষে মত দেন। ইবনু দিহয়া, ইবনুল হাজ, আবু শামাহ, হাফেজ ইবনু হাজার, সুয়ুতি, সাখাভি, মোল্লা আলি কারি প্রমুখ অসংখ্য মনীষী এজন্য মিলাদুন্নবী উদ্যাপনের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। আবার অনেকে এর বিরুদ্ধেও মত দিয়েছেন। যে বিষয়টি নিয়ে সাত আটশ বছর ধরে ইখতিলাফ হয়ে আসছে সেটি সম্পর্কে হুট করে কোনো মন্তব্য করে পার পাওয়া যায় না। আসুন আমরা সবাই রাসুলকে ভালোবাসি। সারা বছর ভালোবাসি। জীবনের প্রতিটি ক্ষণে রাসুলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করি। কেউ নির্দিষ্ট দিনে বা মাসে বিশেষভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করলে সেটি নিয়ে হাঙ্গামা বাধানো থেকেও বিরত থাকি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট