শোকের মাতমে শেষ হলো ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল
ইসলামের ইতিহাসে মহররম মাসের ১০ তারিখ বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন দিন। দিনটি আশুরা হিসেবে পালন করে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়। কারবালার বিয়োগান্তক স্মৃতি স্মরণে শোকের আবহে পালিত হয় পবিত্র আশুরা। করোনা মহামারির ব্যাপক প্রাদুর্ভাবে টানা দুই বছর বন্ধ থাকার পর এবার যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে রাজধানীতে মহররমের ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল বের হয়েছে। এতে শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিমদের ঢল নামে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মিছিলে আসা শিয়া মুসলিমদের বেশিরভাগই কালো পোশাক পরে বুক চাপড়ে ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ ধ্বনি তোলেন। হোসেনি দালান ইমামবাড়া ব্যবস্থাপনা কমিটির আয়োজনে অনুষ্ঠিত মিছিলে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারও চোখে পড়ে।
মঙ্গলবার (৯ আগস্ট) সকাল ১০টায় রাজধানীর হোসেনি দালান থেকে তাজিয়া মিছিলটি বের হয়ে চকবাজার, লালবাগ, আজিমপুর, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট ও সাইন্সল্যাব হয়ে ধানমন্ডি ২ নম্বরে গিয়ে শেষ হয়।
হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেন (রা.) শিশুসন্তান জয়নাল আবেদীন ও তার বংশধরসহ ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদতবরণ করেন। শত শত বছর ধরে শিয়া মুসলিমরা কারবালার শহীদদের স্মরণে শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়ে মিছিল ও শোকের মাতমে দিন পালন করেন।
শিয়া মুসলিমরা তাজিয়া মিছিলে শোকের প্রতীক হিসেবে খালি পায়ে পুরুষরা কালো পাঞ্জাবি-পাজামা এবং নারীরা কালো কাপড় পরে মিছিল করেছে। ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ ধ্বনিতে মাতম ও বুক চাপড়ে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণ করেন তারা। মিছিলে অংশ নেন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ভক্তরা। মিছিলের সামনের কাতারে ছিল ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের দুটি প্রতীকী ঘোড়া, দ্বিতীয় ঘোড়ার জিন ছিল রক্তের লালে রাঙানো।মিছিলের প্রথম অংশে দুটি কালো গম্বুজ বহন করা হয়েছে। জানা যায়, বিবি ফাতেমাকে স্মরণ করে এ গম্বুজ দুটি বহন করা হয়েছে। মিছিলে কালো কাপড় দিয়ে ইমাম হোসেন (রা.) এর প্রতীকী মরদেহ বহন করেন শিয়া মুসলিমরা। ধানমন্ডি লেকে প্রতীকী কারবালা প্রান্তরে এসে মিছিলটি শেষ হয়।মিছিলে অংশ নেওয়া শিয়া মুসলিমদের হাতে লাল, সবুজ, কালোসহ বিভিন্ন রংয়ের নিশান, মাথায় শোকের কালো কাপড় শোভা পায়। এ বছর তাজিয়া মিছিলে প্রায় এক হাজার নিশান উড়ানো হয়। কারবালার স্মরণে কালো চাঁদোয়ার নিচে কয়েকজন বহন করেন ইমাম হোসেনের প্রতীকী কফিন। মাতমকারীদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন সেচ্ছাসেবকরা। তাদের পানি ও শরবত বিতরণ করতে দেখা যায়।মিছিলে অংশ নেওয়া জান্নাতুল ফেরদৌসী নামের এক নারী জাগো নিউজকে বলেন, শত শত বছর ধরে ইমাম হোসেন (রা.) শহীদ হওয়ার দিনটি উপলক্ষে তাজিয়া মিছিল বের করা হয়। এ মিছিল মূলত শোক মিছিল। ইমাম হোসেন ও তার বংশধরদের শহিদী মৃত্যুর প্রতি শোক জানাতেই শোকের মাতমে এই তাজিয়া মিছিল। করোনা বিধিনিষেধের কারণে গত দুই বছর ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিল বের করা হয়নি। এবার মিছিলে অংশ নিতে পেরে ভালো লাগছে।মো. রাকিব নামের একজন বলেন, নিশানটা বহন করতে একটু কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এ কষ্টটা ভালো লাগার। দুই বছর পর শোকের মিছিলে অংশ নিয়েছি।নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা আফরোজা ইসলাম বলেন, আমি প্রথমবারের মতো তাজিয়া মিছিলে অংশ নিলাম। খুব ভালো লাগছে। আমি মূলত তাজিয়া মিছিলের সৌন্দর্য দেখতেই মিছিলে অংশ নিয়েছি।
মিছিলে আসা ঐশী নামের একজন বলেন, ছোট থেকেই তাজিয়া মিছিলে অংশ নিই। পরিবারের সবাই একসঙ্গে আসি। দুই বছর পর মিছিল হওয়ায় এবার অনেক মানুষ অংশ নিয়েছে। সব মিলিয়ে বেশ ভালো লাগছে।
জানা যায় মিছিল শেষে ভক্তরা যে যার মত চলে যাবেন এবং অভ্যন্তরীণভাবে রওজাগুলোতে অনুষ্ঠান হবে। এছাড়া সন্ধ্যায় হোসেনি দালানে শামে গরিবার মজলিশ ও বয়ান হবে। এছাড়া আজ থেকে ঠিক চল্লিশ দিন পর ইমাম হোসেনের চল্লিশা অনুষ্ঠান হবে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে।এদিকে তাজিয়া মিছিল ঘিরে সকাল থেকে হোসেনি দালান এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা জোরদার করতে দেখা যায়। যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে মিছিলের সামনে পেছনে দায়িত্ব পালন করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদস্যরা। ছিল র্যাব ও বিভিন্ন স্তরের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও।
সুষ্ঠুভাবে তাজিয়া মিছিল সম্পন্ন করতে দা, ছোরা, কাঁচি, বর্শা, বল্লম, তরবারি, লাঠি বহন নিষিদ্ধ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একইসঙ্গে আতশবাজি ও পটকা ফোটানোও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।কারবালার শোক ধারণ করে আজ রাজধানীসহ সারাদেশে পবিত্র আশুরা পালিত হচ্ছে। হোসেনি দালান ছাড়াও রাজধানীর আরও কিছু এলাকা থেকে আজ তাজিয়া মিছিল বের করা হয়। দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির মধ্যে তাজিয়া মিছিল ছাড়াও রয়েছে বিশেষ মোনাজাত, কোরআনখানি, দোয়া ও মাহফিল। অনেকে এ দিনে নফল রোজাও রাখেন। অসহায় ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণও করে থাকেন অনেকে।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট