বাংলা নামের দেশ কবে থেকে হল?
আমাদের রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ। পূর্বে আছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার আগে অবধি আমরা একই ছিলাম।এখন বিচ্ছিন্ন। ২০১৬ সালের অগস্ট মাসে আমাদের রাজ্য থেকে একটা প্রস্তাব দেওয়া হয় আমাদের রাজ্যের নাম পরিবর্তিত করে ‘বাংলা’ রাখার জন্য। হিন্দিতে ‘বাঙ্গাল’ ও ইংরিজিতে ‘বেঙ্গল’। কিন্তু তিনটে নাম বিভিন্ন হওয়ায় সেই প্রস্তাব গ্রাহ্য হয় নি।তাই আবার ২০১৮ সালের জুলাই মাসে একটি নতুন প্রস্তাব দেওয়া হয় একটিই নাম ‘বাংলা’ রাখার জন্য। এই নাম পরিবর্তনের মূল কারণ ছিল ইংরেজি বর্ণমালার বিচারে উপরের দিকে উঠে আসা। এতে প্রশাসনিক সুবিধে হয়। কিন্তু সেই প্রস্তাব এখনও গৃহিত হয় নি। এই যে বাংলা নাম-এই নামের উৎপত্তি হল কবে থেকে? কবে থেকে আমরা প্রাচ্যদেশীয়রা বাংলা দেশের অধিবাসী বলে পরিচিত হতে শুরু করলাম এটা জানতে হলে আমাদের অনেক আগে পিছিয়ে যেতে হবে।আর্যরা এদেশে আসার অনেক আগে থেকেই অস্ট্রিক জাতির লোকেরা আমাদের বাংলায় এক উন্নত কৃষিকেন্দ্রীক সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। সভ্যতার ভিত্তি কৃষি হলেও এই অঞ্চলের লোকেরা সমুদ্রবাণিজ্যেও খুব দক্ষ ছিল।সিন্ধুসভ্যতার সময় থেকেই এরা প্রাচীন মিশর,ইরাক, ক্রিট, চিন, গ্রিস,রোম প্রভৃতি দেশের সাথে জলপথে বাণিজ্য বিস্তার করেছিল। সেই আমলের ভারতের অন্যতম প্রধান বন্দর ছিল তাম্রলিপ্তি, তাম্রলিপ্ত বা তমলুক। দীর্ঘদিন এই বন্দর উত্তরভারত ও দক্ষিণভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে অন্যতম যোগসূত্র ছিল।তবে এ কথা ঠিক যে অস্ট্রিকরা দ্রাবিড় সভ্যতার সাথে পরিচিত ও মিশ্রিত হলেও সিন্ধুসভ্যতার নাগরিক জীবনকে সেভাবে গ্রহণ করতে পারে নি। তাই প্রাচীন ভারতে কোশল, মগধ, পাটলিপুত্র, অবন্তী ইত্যাদি নানা নগরের কথা শুনলেও আমরা কিন্তু বাংলায় তেমন নগরের পরিচয় পাই না।
আর্যসভ্যতা বিস্তারের আগে বাংলা অনেকগুলো ‘কৌম’ বা বিভিন্ন গোষ্ঠীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। আর্যসভ্যতার বিস্তার এই বাংলা অবধি প্রসারিত হতে অনেক সময় লেগেছিল। কুষাণযুগের মুদ্রা বাংলায় পাওয়া গেছে।মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তার এক শাসনকর্তাকে বাংলায় নিয়োগ করেন এমন শোনা যায়। তবুও মনে হয় বাংলায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্রবেশ গুপ্তযুগের আগে ঘটে নি। গুপ্তযুগেও পুরো বাংলা আর্যাবর্তের অধিকারে এসেছিল এমন মনে হয় না।শ্রুতিস্মৃতিতে বাংলার কথা নেই। বৌদ্ধদের প্রাচীনতম পুস্তক বিনয়পিটকেও নেই। ঋগবেদের ঐতরেও ব্রাহ্মণে প্রথম ‘বঙ্গ’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং এই অঞ্চলের নিন্দা করা হয়।অনার্য অধ্যুষিত এই অঞ্চল আর্যদের কাছে তখনও অগম্য ছিল। বৌধায়নের কল্পসূত্রের অন্তর্গত ধর্মসূত্রে বলা হয় কেউ বঙ্গে তীর্থযাত্রা ছাড়া অন্য কারণে পুন্ড্র, বঙ্গ ও কলিঙ্গ দেশে যায় তবে তার শাস্তি হবে। এ থেকে বোঝা যায় বাংলায় তখন উন্নত সভ্যতা ছিল।আর্যদের মধ্যে কেউ কেউ তীর্থযাত্রা করতে বাংলায় আসত।বুদ্ধদেব বুদ্ধগয়ার কাছে উরুবেলায় সিদ্ধিলাভ করেন। তিনি মিথিলা, মগধে তার ধর্মপ্রচার করেন। তিনি রাজমহলের কাছাকাছি কাঁকচোল পরগণার সুমেলু উদ্যানে তার ধর্ম প্রচার করেন।তবে গঙ্গা পার হয়ে তিনি রাঢ়, পুন্ড্র ও বঙ্গে আসেন নি। পরশুরাম বাংলায় লৌহিত্য তীর্থ স্থাপন করেন। মহাভারতের ভীম রাজসূয় যজ্ঞের জন্য বাংলার অনেক রাজাকে পরাস্ত করেন। এগুলো বাংলায় ধারাবাহিক আর্য বিস্তারের ইতিহাস বলেই মনে হয়।আর্যরা তখন বাংলার দুটি কৌম গোষ্ঠীর সাথে পরিচিত ছিল। একটি ‘বঙ্গ’ যাদের ঐতরেও ব্রাহ্মণে ‘বয়াংসি’ বা ‘পক্ষী’ বলা হয়েছে। মনে হয় এদের টটেম ছিল পাখি। অন্যটি ছিল ‘পুন্ড্র’। ঐতরেও ব্রাহ্মণে তাদের ‘দস্যু’ বলা হয়েছে। অতুল সুর মনে করেন এই পৌন্ড্রদের থেকেই পরে ‘পোদ’ জাতির সৃষ্টি হয়। বাংলায় আর্যাবর্তের বিস্তারের আগের থেকেই মনে হয় বাংলা পাঁচটি ভাগে বিভক্ত ছিল।বঙ্গ(পূর্ব বঙ্গ), রাঢ়(পশ্চিম বঙ্গ),পুন্ড্র বা বরেন্দ্র(উত্তর বঙ্গ), সমতট বা বাউড়ি(মধ্য ও দক্ষিণ বঙ্গ), বাঙ্গলা(পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গ)। এই অঞ্চলগুলিতে বসবাসকারী লোকেরা স্বাধীনভাবেই বাস করত এবং তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল।আগে বঙ্গ বলতে মূলত ঢাকা, বিক্রমপুর, রংপুর, কুচবিহার ও জলপাইগুড়ির কিছু এলাকা বোঝাত। রাঢ় বলতে এখনকার বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, হাওড়া, হুগলি, মেদিনীপুর ও বর্ধমানের কিছু অংশ বোঝাত।অজয় নদী এই এলাকাকে উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ় এই দুইভাগে ভাগ করেছিল। কেউ বলেন ‘রাঢ়’ শব্দ সাঁওতালি ‘রাঢ়ো’ শব্দ থেকে এসেছে।এর অর্থ নদীগর্ভস্থ পাথুরে জমি। খুব কম সংখ্যক ঐতিহাসিক বলেন এই শব্দ প্রাচীন মিশরীয় থেকে বাংলায় এসেছে।
বরেন্দ্রভূমি ছিল বর্তমান মালদা, দিনাজপুর, পূর্ণিয়া, রাজসাহী এসব অঞ্চল।’বরিন্দ’ কথার অর্থ ‘উচ্চভূমি’।তাই থেকে বরেন্দ্র শব্দ এসে থাকতে পারে। অনেক ভূতত্ববিদের মতে এই অংশ বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন। এই অংশেই মহাস্থান( পুন্ড্রবর্ধনের প্রাচীন রাজধানী), গৌড়( লক্ষণাবতী), পান্ডুয়া( গৌড়ের পরের দিকের রাজধানী) এসব নগরীর নাম পাই।গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মধ্যেকার ত্রিকোণাকার বদ্বীপ সমতট বা বগ্ড়ি নামে পরিচিত ছিল।২৪ পরগণা, সুন্দরবন, যশোর, খুলনা, পাবনা এইসকল অঞ্চল এই এলাকাভূক্ত ছিল। বগ্ড়ি শব্দটি এসেছে ‘ব্যাঘ্রতটী’ থেকে। এই অঞ্চলে খুব বাঘের প্রাদুর্ভাব ছিল বলেই এমন নামকরণ হয়েছিল বলে মনে হয়। দক্ষিণের কিছু অংশ উপবঙ্গ বা বাঙ্গালা নামে পরিচিত ছিল।গৌড়রাজ শশাঙ্কের সময় থেকেই আমরা বাংলায় এই বিভিন্ন অঞ্চলগুলিকে কিছুটা সঙ্ঘবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পাই। তখন বাংলা মূলত তিনভাগে বিভক্ত ছিল। পুন্ড্র বা পৌন্ড্র, গৌড় ও বঙ্গ।তবে এসময় গৌড় যে প্রাধান্য লাভ করে তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। শশাঙ্কের পর পাল এমনকি সেন বংশীয় রাজারাও নিজেদের ‘গৌড়েশ্বর’ বা ‘গৌড়াধিপতি’ বলে পরিচয় দিতেই গর্বিত বোধ করতেন।দীর্ঘদিন বাংলা বলতে গৌড়কেই বোঝাত। কিন্তু গৌড়ের ভাগ্যে এই জয়টিকা হারিয়ে গেল পাঠান আমলে যখন তারা বঙ্গ নামটিকেই গ্রহণ করেন এবং এই পরিবর্তন পূর্ণতা পেল আকবরের সময় যখন সমগ্র বাংলাদেশ ‘সুবা বাংলা’ নামে পরিচিত হল।তবে বঙ্গ নামটি কিভাবে বঙ্গাল বা বাংলা হল তাই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতের অমিল আছে। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী তে আছে এই অঞ্চলের প্রাচীন শাসকেরা বন্যা প্রতিরোধের জন্য ১০ গজ উঁচু, ২০ গজ চওড়া আল দিতেন। বঙ্গ+আল= বঙ্গাল থেকেই বাংলা নামের উৎপত্তি হয়েছে। তবে ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার অবশ্য এই মত স্বীকার করেন না। তবে একথা ঠিক অনেক আগেই রাজেন্দ্র চোল যখন বাংলার এক অংশ জয় করেন তখন তার তিরুসলের শিলালিপিতে ‘বঙ্গাল’ শব্দটি উল্লেখ করেন।তাই এই নামটি অনেক আগে থেকেই বাংলায় প্রচলিত ছিল বলে মনে হয়।এই প্রসঙ্গে যে কথা না বললেই নয় ৩২৭খ্রীঃ পূঃআলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করে পাঞ্জাব বিজয় করেন তখন পাঞ্জাব অনেক ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। সেই সময় ‘গঙ্গারিডি’ বলে প্রাচ্যের এক জাতির শৌর্য বীর্যের কথা শুনে তিনি আর অগ্রসর না হয়ে বিপাশা নদীর পার থেকেই ফিরে যান।এমন কথা টলেমীও বলে গেছেন। গঙ্গারিডিরা দক্ষিণ বঙ্গের বদ্বীপ অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন বলেই মনে হয়। এই অঞ্চলে ‘গঙ্গে’ বলে এক সমৃদ্ধ বন্দর ছিল বলেও শোনা যায়।
এভাবেই বিভিন্ন কৌম ও অঞ্চলে বিভক্ত আমাদের বঙ্গদেশ পাঠান বিজয়ের পর থেকেই ক্রমে বাংলা নামে পরিচিত হল। আজ আবার ন’শ বছর পর আমরা আমাদের রাজ্যের সেই পুরনো নাম রাখার জন্য দরবার করছি। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিকতা থেকে প্রশাসনিক সুবিধাই বিবেচনার বিষয় হলেও নামের ঐতিহ্য ও পৌরাণিকতাকে আমরা কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারি না।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট