সাত বছরে ১৫ শতাংশ বেড়েছে যশোরে, ১৮ হাজার শিশু আছে সীমাহীন ঝুকিপূর্ণ, কাজ করছে শিশুশ্রম
হঠাৎ করেই সপ্তম শ্রেণি থেকে লেখাপড়া বন্ধ করে কাজে যোগ দিতে হয় আরাফাত হুসাইনের। ১৪ বছর বয়েসী আরাফাত পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সেজো। সকাল হলেই তার পাড়ার বন্ধুরা স্কুলে চলে যায়। আর তাদের সাথেই বের হয়ে তাকে যেতে হয় যশোরের একটি মোটর পার্টসের দোকানে। দোকানের বিক্রয় সহকারী হেলপার হিসেবে কাজ করতে হয় তাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে হয় আরাফাতকে।তার ছোট ভাই ছাড়া বাকি চার ভাই বোন শহরের রেলগেটে নানী ফিরোজা বেগমের সাথে বসবাস করে। বেশ আগেই তার বাবা অন্যত্র বিয়ে করে তাদের ফেলে চেলে গেছেন। মাও বিয়ে করে, ছোট সন্তানকে নিয়ে চলে গেছেন অন্য জায়গায়। সব মিলিয়ে নানীর বাড়িতেই জায়গা হয়েছে তাদের।তবে, নানীর সংসারের কিছুটা দায়িত্ব এসে পড়েছে আরাফাতের উপর। দোকানে কাজের ফাঁকে বার বার স্কুলের বন্ধুদের সাথে দৌঁড়াদৌঁড়ির বা খেলাধূলার কথা মনে পড়ে তার। কিন্তু তাদের কথা মনে পড়লেও স্থির হওয়ার জো নেই। সারাক্ষণ দোকান মালিকের কাজের গন্ডির মধ্যেই তাকে সময় পার করতে হয়।আরাফাত মোটর পার্টসের দোকানে কাজ করলেও ১৫ বছর বয়সী হাবিবা খাতুনের স্থান হয়েছে যশোর শহরের রেলগেট এলাকার অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানে। এ প্রতিষ্ঠানে সে পার্টসের প্রসেসিং ও প্যাকেজিং বিভাগের হেলপার হিসেবে কাজ করে। অনেক শখ থাকলেও স্কুলে যাওয়া হয়নি তার। সংসারে অভাব অনটন দেখেই তাকে স্কুলের পরিবর্তে কাজে যুক্ত হতে হয়েছে বলে মন্তব্য করেন হাবিবা। মন চায়, কেউ যদি সংসারের খরচ চালিয়ে দিতেন তাহলে সে স্কুলমূখী হতো। সবার ভাগ্যে কি আর লেখাপড়া জোটে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করে হাবিবা।শুধু আরাফাত বা হাবিবা নয়, যশোরের বিভিন্ন কারখানা ও দোকানে কয়েক হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত। ফলে দিন দিন যশোরে বেড়েই চলেছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমিকের হার। একটি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, গত ৭ বছরে তা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশু শ্রমিকের হার দিন দিন বৃদ্ধি হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক সহিংসতা, দারিদ্রতা ও কুসংস্কার, দ্রব্য মূল্যের উর্দ্ধগতি, অভিভাবকের উদাসীনতার জন্যই শিশু শ্রমিকের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সাথে শিশু সুরক্ষায় নেই সরকারের স্থায়ী কোন উদ্যোগ। অনেকটা দাতা সংস্থার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয় বলেও দাবি তাদের।
২০১৫ সালে যশোর জেলায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ১৬ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত ছিল। ওই জরিপে সবচেয়ে বেশি শিশু শ্রমিক বাস-ট্রাকের হেলপার, লেদ শ্রমিক, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, স্টিল, গাড়ি ও মেটাল ফার্নিচার শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, ওয়েল্ডিং শ্রমিক, বৈদ্যুতিক সামগ্রী উৎপাদন কারখানা, পাথর ভাঙা শ্রমিক, ব্যাটারি তৈরি শ্রমিক, বিভিন্ন কারখানা, মিল, ওয়ার্কশপে শিশুরা ঝুঁকি নিয়ে কাজে জড়িত এমন তথ্যই ওঠে এসেছে আব্দুর রশিদ খান ঠাকুর ফাউন্ডেশন (এআরকেটিএফ) পরিচালিত এক জরিপে।জরিপে আরও উঠে এসেছে, ২০১৫ সালে যশোরে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমিক ছিল ১৬ হাজার, ২০১৬ সালে ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে এর সংখ্যা দাড়ায় ১৮ হাজার ৮০ জনে, ২০১৭ সালে ১০ শতাংশ বেড়ে ১৭ হাজার ৬শ’ জন, ২০১৮ সালে ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে সংখ্যা হয় ১৭ হাজার ৯শ’ ২০ জন, ২০১৯-২০২০ সালে ১৫ শতাংশ বেড়ে ১৮ হাজার ৪শ’, ২০২১ সালে ১৪ শতাংশ বেড়ে সংখ্যা দাড়ায় ১৮ হাজার ২শ’৪০ জনে।
এআরকেটিএফ-এর যশোর অঞ্চলের কো-অডিনেটর আব্দুর রহমান বলেন, জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু। দরিদ্রতা এবং পারিবারিক বিচ্ছেদে যশোরে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। শিশু শ্রমিকের ৯০ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। ৪৭ ধরনের কাজ করে শিশু শ্রমিকরা। যে কাজের অনেকগুলো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, সমাজ বিজ্ঞানিদের মতে, দরিদ্রতা, পারিবারিক বিচ্ছেদ, স্থায়ী বিচ্ছেদ, পিতা-মাতার পেশা, অভিভাবকের মৃত্যু, অনাকর্ষণীয় শিক্ষাসহ ২৫টিরও বেশি কারণে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। মাত্র ১০ শতাংশ শিশু শ্রমিক কাজ করছে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। খুবই কম মজুরিতে নিয়োগ দেয়া হয় শিশুদের। অনেক শিশু শ্রমিক বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে করতে এক সময় ওরা মাদক এবং অপরাধ জগতের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় অথবা সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় দরিদ্র শিশু শ্রমিকদের যথাযথ পরিচর্চার মাধ্যমে যদি কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তোলে, তাহলে ওরা দেশের মানব সম্পদে পরিণত হতো।
এদিকে দেশের শ্রম আইন বলছে, কোন প্রতিষ্ঠানে অল্প বয়সীদের কাজে নিয়োগের আগে সে শিশু না কিশোর সে বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে জন্মনিবন্ধন সনদ, স্কুল সার্টিফিকেট বা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে। কোনো অভিভাবক তার কিশোর ছেলেকে কাজের জন্য অনুরোধ করলে একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কিশোরকে পরীক্ষা করে কাজের কতটুকু সক্ষমতা তার সিদ্ধান্ত দেবেন। সরকার বিভিন্ন সময়ে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকা ঘোষণা করবে। এই কাজে কোনভাবেই শিশু নিয়োগ করা যাবে না। চিকিৎসকের সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে কোনো কিশোরকে কোন কারখানায় হালকা কাজে নিয়োগ দিলেও দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যবর্তী সময়ে কাজ করানো যাবে না। অথচ এই আইন কোথাও মানা হয় না। সকল স্থানেই শিশুরা সব সময় ঝুঁকির মধ্যেই থাকেন বলে একাধিক তথ্য মিলেছে।যশোরের আরএন রোডে মোটরসাইকেলসহ নানা ধরনের গাড়ির পার্টস বিক্রি হয়। এখানে প্রায় প্রতিটি দোকানেই ঝুঁকি নিয়েই ভারি ভারি পার্টস বিক্রির জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়াসহ নানা ধরনের কাজ করে। দোকান মালিকরা বলছেন, একজন পূর্ণ বয়স্ক শ্রমিকের যে পরিমান বেতন দিতে হয় তা দিয়ে কমপক্ষে ৫ জন শিশু শ্রমিক রাখা যায়। যার জন্য অধিকাংশ শ্রমিক শিশু শ্রেণির।এ ব্যাপারে যশোর মটর পার্টস ও টায়ার টিউব ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহিনূর হোসেন ঠান্ডু বলেন, শিশুদের কম টাকায় পাওয়া যায় এবং কাজও ভালো করে, যার জন্য দোকানদাররা শিশুদের নিয়ে কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।শিশু সুরক্ষা নিয়ে তিনি বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে তারা বলেন কিন্তু অনেকেই এসব মানেন না। তবে, তিনিসহ অনেক দোকান বা কারখানা মালিক আছেন যারা কাজের পাশাপাশি লেখাপড়ারও সুযোগ দেন।শিশু সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী জাকিয়া খাতুন বলেন, ‘আমরা শিশুদের নিয়ে কাজ করে আসছি। শিশুরা পড়াশোনার বয়সে যেন কাজে না যায়, সে দিকটা নিশ্চিত করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন বলে মন্তব্য করেন। শিশুদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি করতে, তাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতেই তারা কাজ করছেন।’তিনি আরও বলেন, তাদের একটি জরিপে শুধু মাত্র আর এন রোড থেকে মুড়লি মোড় পর্যন্ত এই একটি সড়কেই প্রায় ৭ হাজার ৫শ’ শিশু শ্রমিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে।তবে করোনার কারণে এর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন। কারণ অনেক অভিভাবক করোনাকালীন বেকার হয়ে পড়েন। এ সময় অনেক শিশুই তাদের পরিবারের আর্থিক সাপোর্টের জন্য কাজে নেমে পড়ে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে হবে সকলকে। দেশের ভবিষ্যৎ হাল যারা ধরবে তারা যদি শিক্ষার বয়সে কাজে নামে, তাহলে জাতি পিছিয়ে পড়বে। কেবল দাতা সংস্থা দিয়ে নয়, এখানে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকেও বলে মন্তব্য তার।কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর যশোরের উপ মহাপরিদর্শক আবদুল কাইউম বলেন, শিশু শ্রম নিরসনের জন্য তারা কাজ করছেন। গত বছর শিশু শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোর দায়ে ৭০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে, তা আসলে সাময়িক নিরসন, দু’দিন পরই আবারও ওই শিশু দরিদ্রতার জন্য কাজে যোগ দেয়। যশোরে এই মুহূর্তে সরকারের তেমন কোন প্রকল্প নেই। তবে মন্ত্রণালয়ে কিছু প্রকল্প আছে, তাও আবার জেলা পর্যায়ে নয়।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট