✒️মোহাম্মাদ আজিজুল হক
সেদিন ছিল শুক্রবার। আমি
মোটরবাইক নিয়ে লংজার্নিতে খুব বেড়িয়েছি। চলনবিলের তলদেশ থেকে, সেই নাটোরের বনলতা সেন পেড়িয়ে, আমার প্রিয় বন্ধুবর দিপু দত্ত, নুর আলম ও ব্রাক কর্মকর্তা শাহীন ভাইয়ের অনুরোধে, মেঘলা সিমান্তে ঘুরতে বের হলাম। দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল সেখানে আমার যাওয়া । আমার ছোট্ট বাইকটিকে পেছনে ফেলে নুর আলম ও শাহীন ভাই বীরদর্পে ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খলজির ন্যায় ছুটন্ত ঘোরসওয়ার হয়ে কিশোরগঞ্জ হাওরে হাজির হয়। আমি দিপু দত্তকে নিয়ে সাদা বলাকার ন্যায় উড়ে উড়ে খোলা আকাশের বুকে, মন মেলে ধরে শরতের কাশবনের ওপর দিয়ে চলছি তো চলছি। চলনবিল পাড়ি দিয়ে খাপখোলা বাজারে বন্ধুতুল্য ছোটভাই মানিক মিয়ার আমন্ত্রণে চা-চক্রের বিরতিতে হঠাৎ দেখা মেলে, এক বাক- প্রতিবন্ধী ছান্নান মিয়ার সাথে। তার মিষ্টি হাসিই বলে দেয় আমাদের আনন্দ ভ্রমণের প্রাণচঞ্চল ইঙ্গিতময় দৃশ্যগুলো। ছান্নান মিয়ার বয়স ৩৫ হলেও তার চেহারা ও ভাবভঙ্গিতে কিশোর মনের অধিকারী । তার সেই হাসিতে মুগ্ধ হয়ে বুকে জড়িয়ে ক্যামেরা বন্দী হই আমি। তার কাছে বিদায় নিয়ে ময়মনসিংহ শহরের ঘুনটি গ্রামে মধ্যান্য ভোজ সেরে পড়ন্ত বিকেলে, শ্যালক রাজিবের কথাতে কিশোরগঞ্জ যাওয়ার রুট বদলে ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন স্থান দর্শনে মনস্থির করি। সেখানে বন্ধু আকরাম খান আমাদের সাথে যুক্ত হয়। গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে সেখানেই রাত্রি যাপন করি। নদেরচাঁদ মহুয়ার স্মৃতি বিজারিত মেঘলা সিমান্ত আমাকে হাতছানি দেয়। আমার লোভ আছে যেখানেই যাই, সে এলাকার ইতিহাস ঐতিহ্য বুকে ধারন করে আত্মিক ক্ষুধা নিবারণ করি। মনে পড়ে ড.দিনেশ চন্দ্র সেনের সৃষ্টি ময়মনসিংহ গীতিকার কথা। মহুয়ার প্রেমে নদের চাঁদ জমিদারির আলিশান আবিজাত্য ছেড়ে তার সাথে থেকে যাওয়া। সেই আবেগী মন আমার পরের দিন নেত্রকোনা জেলার কাংস নদীর অপরূপ সৌন্দর্য্য অবলোকন করে করে দুর্গাপুরের দিকে অগ্রসর হই। সেখানে মেঘালয় সীমান্ত যেনো নুঁয়ে আছে উচু নিচু পাহাড় ছুঁয়ে সুমেশ্বরী নদীর বালু ও পাথর উত্তোলন দৃশ্য, যা আমার চিন্তার বাইরে ছিল। শতশত রাস্ট্রন মেসিনের বিকট শব্দ আর ট্রাকের নুড়ি পাথর বহনের প্রতিযোগীতা দেখে মনোজাগতিক চিন্তায় অভিভূত হয়ে যাই আমি। সময় দ্রুত গড়িয়ে যায় রানারের মত, কখন যেন পুর্ব আকাশে লাল টকটকে সূর্যটা উদিত হল, আমাদের চিন্তা গোধুলির আগেই, অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। মোটরবাইক চলছে তো চলছেই অজানার উদ্দেশ্যে, কিছুদুর পথ পাড়ি দিয়েই রাণীখং খ্রিস্টান মিশনে প্রবেশ করি। সুমেশ্বরী নদীর তীরে পাহাড়ের চুড়ায় এ মিশন অবস্থিত। সেখানে নিজের পরিচয় দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। শান্ত পরিবেশে স্থানীয় খ্রিস্টান মহিলারা দল বেঁধে প্রার্থনা করতে এসেছে । যিশুর মুর্তি যেন নিরব দাঁড়িয়ে তাদের মনের গোপন কথাগুলো শুনে মিটিমিটি করে হাসছে। সেখান থেকে আমরা আবার রওনা হলাম বিজিবি ক্যাম্পে, সেখানে একজন মুসলিম, মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসাবে দায়িত্ব পালন করছে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করি সামনের গতিপথ। তার মিষ্টি বাচনভঙ্গিতে আমাদের দিকনির্দেশনা দিলেন। আমরা তার নিকনির্দেশনা মত পাহাড়ের নিচে ছোট্ট একটি সীমান্ত হাট সেখানে উঠি। পাহাড়ের ছোট ছোট চুড়া ঘুরে ঘুরে সেখান থেকে কিছু ইন্ডিয়ান প্রসাধনি ক্রয় করে সামনে চলতে থাকি। তারপর সেই মেঘালয় সীমান্তের অদেখা পুরোনো বন্ধুবরেষু বংশীর দিকনির্দেশনা পেয়ে পেয়ে আমরা চিনামাটির পাহাড়, সবুজের নীল জল আর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করে করে চলার পথে পড়ে চন্ডিগড় আশ্রম পরিদর্শন করে অবশেষে গোধূলি ক্ষণে কলমাকান্দায় এসে পৌছলাম। আগে থেকেই বংশী ও তার বন্ধুরা আমাদের গ্রহণ করার জন্য বসে ছিল একটি কপি হাউজে। সেখানে যাওয়ার পর বংশী তার কবিতা দিয়ে সাদরে গ্রহণ করে কফি হাউজের আড্ডা শেষ করে হোটেলে উঠে বিশ্রাম নিলাম। বংশি চলে যায় তার নিজ আলয়ে, সন্ধ্যার পর পরই আবার তার বন্ধুদের সাথে চা-চক্রে মিলিত হই। সেখানে কয়েকজন সাংবাদিক কাজল তালুকদার, শেখ শামীম, আব্দুর রসীদ আকন্দ, ওবাইদুল পাঠান ও কিছু ছড়াকারদের আপ্যায়নে মুগ্ধ হই। কিছু সময় আড্ডা শেষে বিছানায় যাই। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় আগামীকাল আমরা কোথায় যাচ্ছি।
পরের দিন সকালে বংশী রেডি হয়ে, অনুচরের মত আমার সহযাত্রী হয়। রাস্তার মাঝে আমরা সকালের খাবার শেষ করে সামনের দিকে এগোতে থাকি। চোখের নিকটবর্তী হতে থাকে, সৃষ্টার সৃষ্টি কুলের কারিগরির বিস্ময় সৃষ্টি। বংশী দেখাতে থাকে তার এলাকার অপরূপ সৌন্দর্য্যের নীলিমা। পাহাড়ের পাদদেশে সমতল ভূমিতে গিয়ে বংশী বলে ওঠে, এখানে কালিদাস সাগর ছিল। এখানে চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গার একটির নির্দেশন এখনো তার স্মৃতি বহন করে। ভাবতে অবাক লাগে, কালীদাস সাগরের চিহ্ন টুকু আজ নেই। অনেকে মনে করে সপ্তডিঙ্গার একটি ড্রোন এখানে এসে জলে ডুবার সময় একটা মাথা অর্থাৎ গোলাই সাগরের তলদেশে অন্য মাথা উপরে ছিল। যার শেষ চিহ্ন এখনো বহন করছে। কথার ছলে ছলে আমরা গাড়ো আদিবাসী হাজং সম্প্রদায়ের বাড়ির ভেতর দিয়ে পাহাড়ের তলদেশে দাঁড়িয়ে সবুজ গাছপালার সৌন্দর্য উপভোগ করে করে ঝরনার স্বচ্ছ পানির একটু পরশ নিলাম। সেদিনের সেই সময়টা যেন পাল্লা দিয়ে চলে গিয়েছিল। আমরাও সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন স্থানে ছুটে বেড়িয়ে ছিলাম। দুপুরের খাঁ খাঁ রোদে হাজির হলাম পাতলাবন ছড়ায়। সেখানে বিজিবি সদস্যরা বাঁধা সৃষ্টি করলেও বংশী নিজের পরিচয় দিয়ে আমাদের অনুমতি মেলে। বংশী আপ্রাণ চেষ্টা করেছে কোন কিছুতে যেন আমাদের অপূর্ণতা না থাকে। সামনে যেতেই চোখে পড়ে পাতলাবন ছড়ার স্বচ্ছ জলের পানিতে নেমে শত শত অসহায় মানুষ ছোট ছোট নৌকা নিয়ে নুড়ি পাথর তোলার দৃশ্যপট। আমি লোভ সামলাতে পারলাম না। ওদের মত আমিও পানিতে নেমে গেলাম। সাথে সাথে বন্ধু দিপু দত্ত ও বংশীও। আমরা জলকেলিতে মেতে উঠলাম। আমাদের আনন্দে হয়তো বিজিবি সদস্যদেরও মন মেতে উঠেছিল। আমাদের অমন জলখেলা দেখে। তাদের মধ্যে একজন অফিসার আলম সাহেব আমাদের উত্তর বঙ্গের নওগাঁ জেলার ছিলেন। আমার পরিচয় পেয়ে তিনি যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখালেন। আমরা পাথর ও বালি নিয়ে আনন্দে মেতে উঠি। সময় আমাদের ভুলে চলতে থাকে। আমরা বেলা দুটোয় সেখান থেকে বিদায় নিলাম। কিছুটা সামনে পাঁচগাও ছড়া পাড় হয়ে কাশবনে একটু লুকোচুরি খেলা করে বাড়ির পথে রওনা হলাম। বংশী আমাদের নিয়ে চোরাকারবার পরিচালিত হয় এমন কিছু সীমান্ত রাস্তা দিয়ে নিয়ে এলো। সে যদি সেদিন আমাদের সাথে ভ্রমণ সঙ্গী না হতো, তাহলে হয়তো অনেক সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হতাম। পড়ন্ত বিকেল দুপুরের খাবার খেয়ে বংশীর কাছে থেকে বিদায় নিলাম। বিদায় বেলায় আপ্লূত মন ও চোখের চাহুনি সত্যিই যেনো বেদনার বুঝে নিলাম। বংশী নিরব মনে অনুসন্ধান করতে থাকে আমাদের চঞ্চলতা। মোটরবাইক নীড়ের টানে ছুটে চলে। কলমাকান্দা ত্যাগ করতেই চলনবিলের জমজ বোন উব্দাখালি বিলের দেখা মেলে। বিশাল বিলের রাস্তা বেয়ে দুর্দান্ত বাতাসের প্রতিবন্ধকতা ভেদ করে চলতে থাকলো আমাদের মোটরবাইক। বিদায় হে সৌন্দয্যের ঢালী মাখা চির সবুজের বুকে গালিচা পাতানো জাজিমে মোড়ানো মেঘলায় সীমান্তের সাধক রাণী, বিদায় হে বংশি….
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট