মহারাণী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত নাটোর রাজবাড়ি
হোমশিখা দত্তবর্তমান বাংলাদেশের একটি জেলা নাটোর। ইংরেজ শাসনামলে সুদীর্ঘ ৫০ বছর নাটোরের জমিদার ছিলেন মহারাণী ভবানী। তাঁর পিতা আত্মারাম চৌধুরী ও মাতা তমাদেবী চৌধুরী। জন্মভূমি সেসময়ের বগুড়া জেলার আদমদিঘী থানার ছাতিয়ান গ্রাম। খুবই অল্পবয়সে ভবানীর বিয়ে হয় নাটোরের জমিদার রাজা রামকান্তের সাথে। তাঁদের দুই পুত্র ও এক কন্যা জন্ম নিলেও পুত্র দু’টি অকালে মারা যায়। কন্যার নাম তারাসুন্দরী। পরে তাঁরা রামকৃষ্ণ নামে একটি ছেলেকে দত্তক নেন।১৭৮৬ সাল পর্যন্ত নাটোর রাজ্য ছিলো ভারতবর্ষের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ জমিদারি, যার সিংহভাগ অবদানই মহারাণী ভবানীর। দেখে আসা যাক ইতিহাস কী বলে।মোঘল শাসনামলে রাজশাহীর পুঠিয়ার রাজা নরনারায়নের লস্করপুর পরগনার বাড়ইহাটি গ্রামের তহশীলদার যিনি ছিলেন, তাঁর নাম ছিলো কামদেব। তাঁর দুই পুত্র রামজীবন আর রঘুনন্দনও পুঠিয়ায় থেকেই লেখাপড়া করতেন। রঘুনন্দন ছিলেন বেশ মেধাবী। লেখাপড়ার পাশাপাশি তৎকালীন রাষ্ট্রীয় ভাষা পারসিতে বুৎপত্তি লাভ করেন তিনি। পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণের সহযোগিতায় নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর অধীনে চাকরি পান তিনি। পরবর্তীতে নিজ প্রতিভাবলে রঘুনন্দন নবাবের দেওয়ান নিযুক্ত হন। সেসময় তিনি রাজস্ব প্রদানে অক্ষম এমন অনেক জমিদারের জমি নিলামে কিনে ভাই রামজীবনের নামে বন্দোবস্ত করে নিয়েছিলেন। ১৭০৬ সালে পরগনা বানরগাছির বিখ্যাত জমিদার গণেশরাম রায় ও ভগবতীচরণ চৌধুরী রাজস্ব দিতে না পেরে জমিদারিচ্যুত হন। রঘুনন্দন ওই পরগণা রামজীবনের নামে বন্দোবস্ত করে নেন এবং উৎপত্তি ঘটে নাটোর রাজবংশের।জমিদারী স্থাপনের জন্য রঘুনন্দন ও রামজীবন নির্বাচন করেন ভাতঝাড়া নামক একটি বিল। এই বিল ছিলো পুঠিয়ারাজ দর্পনারায়ণের সম্পত্তি। তাঁর কাছে আবেদন করলে নতুন রাজাকে দর্পনারায়ণ জমিটি ব্রহ্মোত্তোর দান করেন। রামজীবন সে জায়গা বসবাসের উপযুক্ত করে তোলেন। নাম দেন নাট্যপুর। ১৭০৬-১৭১০ সালে নির্মিত হয় রাজবাড়ি। এরপরে রাজ-আমলা, কর্মচারী নানান লোকের সমাগমে অল্পদিনের মধ্যে এলাকাটি শহরে পরিণত হয়। সেই নাট্যপুর শহরই আজকের নাটোর।
রাজা রামজীবন নাটোর রাজবংশের প্রথম রাজা। তিনি ১৭০৬ সাল (মতান্তরে ১৭১০) থেকে ১৭৩০ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। একমাত্র পুত্রের অকালমৃত্যু হলে তিনি রামকান্তকে দত্তক নিয়েছিলেন। ১৭৩০ সালে রামকান্তের সাথে রাণী ভবানীর বিয়ে হয়। সে বছরই ১৭৩০ সালে রাজা রামজীবন মারা যান। রাজা হন রামকান্ত। ১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্ত মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তৎকালীন নবাব আলীবর্দী খাঁ জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব দেন রাণী ভবানীর ওপর।রাণী ভবানীর রাজত্বকালে জমিদারি বর্তমান নাটোর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে, যা ছিলো ১২ হাজার বর্গ মাইলেরও বেশি। এজন্য রাণী ভবানীকে বলা হতো অর্ধবঙ্গেশ্বরী। এছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসা, পানীয়জলের ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, দানশীলতা ও ধর্মীয় কাজকর্মের প্রসারের কারণে প্রজারা সম্মান করে তাঁকে ‘মহারাণী’ ডাকতো।ইংরেজ লেখক হলওয়েল বলেছেন, রাণী ভবানীর জমিদারীর বার্ষিক খাজনা ছিলো সে যুগের হিসাবে প্রায় ৭ লাখ রুপি এবং বার্ষিক অর্জিত রাজস্ব প্রায় ১৫ লাখ রুপি। তিনি আরও বলেন, বাংলার নবাব এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি– দু’পক্ষই রাণীকে বেশ সমঝে চলতেন। তবে, রাণী ভবানী পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পক্ষই নিয়েছিলেন এবং সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন তাঁর হয়ে লড়ার জন্য।
রাণী ভবানী ১৮০২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ৮৬ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। রাজ্যভার নেন তাঁর দত্তকপুত্র রামকৃষ্ণ। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর রাজবাড়ি বড়তরফ ও ছোটতরফ- দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। রামকৃষ্ণের দুই সন্তান বিশ্বনাথ (বড়তরফ) ও শিবনাথ (ছোটতরফ)।
রাণী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত মূল ভবনটিই রাণী ভবানীর রাজবাড়ি, অর্থাৎ নাটোর রাজবাড়ি। এটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন। মোট আয়তন ১২০ একর। বিশাল এলাকা জুড়ে আছে কারুকার্যখচিত ছোট-বড় আটটি ভবন। প্রতিটি ভবনের বাইরে আছে লোহার তৈরি লাগোয়া ঘোরানো সিঁড়ি। তাছাড়া আছে দু’টি গভীর পুকুর ও পাঁচটি ছোট পুকুর- জলটুঙ্গি, তারকেশ্বর, গোপীনাথ, আনন্দ ও মহাল। বিশাল এক পুকুর আছে বাড়ির প্রবেশমুখেই, এর শানবাঁধানো ঘাটের স্থাপত্যশৈলী রীতিমতো মুগ্ধ করার মতো।রাজবাড়ি ঘিরে আছে দুই স্তরের বেড়চৌকি। জানা যায়, বহিশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে এগুলো তৈরি করা হয়। আঙিনাতেই আছে বিশালকায় আটটি শিবমন্দির। অপূর্ব মন্দিরগুলোর দেয়ালজুড়ে টেরাকোটার শিল্পকর্ম। এছাড়াও আছে শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালীবাড়ি মন্দির ও তারকেশ্বর শিবমন্দির।
পুরো রাজবাড়ি ঘিরে আছে বিশাল সব গাছ, আছে নানা জাতের ফুলগাছ। খানিক সামনে ডানদিকে বিশাল মাঠটির ধারে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে সামান্য দূরেই অবস্থিত রাণীমহল, যেখানে রাণী ভবানী থাকতেন। সেটি এখন ভগ্নপ্রায়, সাইনবোর্ড পড়ে চিনে নিতে হয়। এখানে একটি অতিথিশালা আছে, সেটিরও অবস্থা ভাঙাচোরা। তবুও ওই অতিথিশালা দেখেই কিছুটা ধারণা করা যায় কেমন ছিলো সেকালের নাটোর রাজার অতিথিসেবা।
রাণী ভবানীর পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে রাজা জগদিন্দ্রনাথ উল্লেখযোগ্য। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র যোগিন্দ্রনাথ বড়তরফের রাজা হন। কিন্তু তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন। এজন্য তাঁর দুই পুত্র একে একে রাজ্যভার নেন। কিন্তু তাঁদের কারো সন্তান ছিলো না। ফলে একসময় রাজবংশের পরিসমাপ্তি ঘটে।
১৯৮৬ সাল থেকে রাজবাড়ির পুরো এলাকাটি রানী ভবানী কেন্দ্রীয় উদ্যান বা যুবপার্ক হিসাবে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে।
(কোলকাতার ম্যাগাজিন ‘ভ্রমণপিপাসু’র ‘শতাব্দী প্রাচীন রাজবাড়ির ইতিহাস’
লেখক পরিচিতি: হোমশিখা দত্ত, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট