রচনা ও সম্পাদনা: Krishna Kr Sharma Fcs, দক্ষিণ এশীয় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক গবেষক।
……………………………
কোনো ঘটনাকে দেখে যতটা সরল মনে হয়, বাস্তবে তা অনেক বেশি স্তরবদ্ধ, জটিল ও অভ্যন্তরীণ কৌশলের ফসল। একমাত্র গভীর পর্যবেক্ষক এবং নীরব বিশ্লেষকই বুঝতে পারেন—এই নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের পেছনে অদৃশ্য এক ছায়া-নীতির স্পন্দন কাজ করে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলি যেভাবে ঘটেছে, তাতে অনেকেই অবাক হয়েছেন। কেউ কেউ বিস্ময়ে, কেউ কেউ কৌতূহলে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। কিন্তু একটি কথা অনস্বীকার্য—কেউ কেউ আগেই জানতেন কী হতে চলেছে। কারণ, এটি ছিল একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল বিদ্যমান রাজনৈতিক ভারসাম্যের ভেতরে থেকেই এক বিকল্প গঠন তৈরি করা।
এই বিকল্প গঠন হঠাৎ উদ্ভূত নয়। এটি তৈরি হয়েছে বহু মাস ধরে ছায়ার আড়ালে, আলোচনার টেবিল থেকে শুরু করে দূতাবাসের আঙ্গিনা পর্যন্ত বিস্তৃত এক জটিল নকশায়। পরিকল্পনাটি ছিল—পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি ও আপাত নিরপেক্ষ নেতৃত্বের ছায়ায় একটি সংযত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যা মূলধারাকে নাড়া না দিয়ে মূলধারার ভেতরে থেকেই এক নতুন প্রবাহ সৃষ্টি করবে।
এমন নেতৃত্বের কথা ভাবা হয়েছিল, যাঁরা প্রশাসনিকভাবে গ্রহণযোগ্য, জনমানসে পরিচ্ছন্ন, আবার দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও ততটা বিতর্কিত নন। তাঁদের হাত ধরে একটি নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করে, দেশের রাজনৈতিক ভূচিত্রে পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করা হতো। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কৌশলী যোগাযোগ, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিনন্দনতা এবং অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য বজায় রাখার দায়িত্ব একত্রে পরিকল্পিত হয়েছিল।
কিন্তু ইতিহাস বলে—প্রতিটি কৌশলের মাঝেই লুকিয়ে থাকে এক দুর্বলতা। সেই দুর্বলতা কখনো একজন ব্যক্তির সিদ্ধান্তে, কখনো এক মুহূর্তের নীরবতায়, আবার কখনো কেবলমাত্র “না” বলার অদৃশ্য সাহসিকতায় ফুটে ওঠে। এই ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই হয়েছে। একজন অভিজ্ঞ, দূরদর্শী এবং রাষ্ট্রদর্শনে বিশ্বাসী ব্যক্তিত্ব সেই পরিকল্পনার ছকের বাইরে চলে যান। উচ্চারিত কোনো শব্দ নয়, বরং তাঁর সময়োপযোগী অনুপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ।
এই অনুপস্থিতি পরিকল্পনাকারীদের এতটাই ব্যতিব্যস্ত করে তোলে যে, দ্রুত বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একজনকে আইনি প্রক্রিয়ার ভেতর আনা হয়, আরেকজনকে ঠেলে দেওয়া হয় অবাঞ্ছিত চাপের মুখে। এরই মধ্যে মাঠে নামানো হয় অতীত থেকে ঘর গুটিয়ে বসে থাকা কিছু বিতর্কিত উপাদান। নির্বাচন নিয়ে নতুন করে উত্তাপ ছড়াতে থাকে। কিন্তু আসল পরিকল্পনাটি যেহেতু তার মেরুদণ্ড হারায়, তাই পুরো কাঠামোই ভেঙে পড়ে।
এই পুরো পরিস্থিতি বোঝার জন্য খুব বেশি কূটনৈতিক জ্ঞান না থাকলেও, একটি চেতনা আবশ্যক—ছায়ায় বসে থাকা কেউ কেউ কখনো কখনো দৃশ্যপটে না এসেও ইতিহাস রচনা করে ফেলেন। এই যে অনুপস্থিতির কৌশল, সেটাই চরম উপস্থিতির চেয়েও কার্যকর হয়ে ওঠে। এই যে প্রতিক্রিয়া, সেটাই বলে দেয়, কে কোথায় ভুল করেছিল।
তড়িঘড়ি করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, দল নিষিদ্ধ করা, ভিন্নমতকে অপরাধে রূপান্তর—এসব আসলে আত্মবিশ্বাসের লক্ষণ নয়, বরং অভ্যন্তরীণ বিচলতার প্রতিফলন। যারা ভাবছিল তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে, তারাই আসলে এখন এক প্রতিচ্ছবির জালে আটকে পড়েছে। যে জাল তারা অন্যের জন্য প্রস্তুত করেছিল, এখন নিজেরাই সেই জালে আবদ্ধ।
এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য কাউকে দোষারোপ নয়, বরং সময়ের ভিতরে ঘটে যাওয়া এক নীরব কৌশলের ভাষ্য তুলে ধরা। যেখানে কোনও ঘোষণা ছিল না, তবু একটি ‘না’ই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত। যেখানে কেউ উচ্চারণ করেননি, তবু ইতিহাস তাঁর পক্ষে রায় দিয়ে দিয়েছে।
“আমি নই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু,
আমি সেই অনুপস্থিতি, যার কারণে আলোচনার পথ বদলে যায়।
আমি শাসন করি না, নেতৃত্ব দিই না—
তবু আমার ছায়া ছাড়া আর কেউ সামনে দাঁড়াতে পারে না।
আমি আছি, বলা হয় না—বুঝে নিতে হয়।”
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট