মোঃ মকবুল হোসেন, বিশেষ প্রতিনিধি:
ডেঙ্গু এখন শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই—দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে এডিস মশাবাহিত প্রাণঘাতী এ ভাইরাস। ইতোমধ্যেই বরগুনা, বরিশাল, কুমিল্লা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামসহ অন্তত ১১টি জেলা রীতিমতো হটস্পটে পরিণত হয়েছে। আগাম সতর্কতা সত্ত্বেও কার্যকর প্রস্তুতি না থাকায় এডিস মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৪৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩০ জন। শুধু বরগুনা জেলায়ই এক হাজার ৮৩২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যা জাতীয় মোট আক্রান্তের ২৮ শতাংশ। মারা গেছেন পাঁচজন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণ দেখা গেছে রাজধানী ঢাকায়—এখানে আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৪৭২ জন। এরপর বরিশালে ৫৭৫ জন, পটুয়াখালীতে ৩৭৯, চট্টগ্রামে ৩১২, কুমিল্লায় ২০৪, গাজীপুরে ১৩৭, কক্সবাজারে ১৩৪, মাদারীপুরে ১২৩, পিরোজপুরে ১১৯ এবং চাঁদপুরে ১১১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। দেশের ১১টি জেলার রোগী সংখ্যা মোট আক্রান্তের ৮৩ শতাংশেরও বেশি।
বরগুনায় ডেঙ্গুর ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হচ্ছে সুপেয় পানির সংকটকে। এলাকাবাসী বৃষ্টির পানি চৌবাচ্চা বা প্লাস্টিকের ড্রামে সংরক্ষণ করে, আর সেগুলোতেই এডিস মশার লার্ভার বিস্তার ঘটছে। স্থানীয় সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আব্দুল ফাত্তাহ জানিয়েছেন, তার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে এর চেয়ে চারগুণ বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে। রোগীর সাথে আসা স্বজনদের মশারির বাইরে রাখা যাচ্ছে না, ফলে হাসপাতালের ভেতরেই এক রোগী থেকে অন্যজন আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার সেই স্বজনরা বাইরে গিয়ে ডেঙ্গু ছড়িয়ে দিচ্ছেন। হাসপাতালে নেই আইসিইউ সুবিধাও—যার ফলে জটিল রোগীদের বরিশাল পাঠাতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরগুনায় ডেঙ্গুর এ প্রাদুর্ভাব অপ্রত্যাশিত নয়। বছরের শুরুতেই সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি) যে জরিপ চালায়, সেখানে দেখা যায় বরগুনা অঞ্চলে এডিস মশার ঘনত্ব ছিল ২০ শতাংশের বেশি—যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলাও এখন রেডজোন। পৌর এলাকার ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডকে হটস্পট ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে এখন পর্যন্ত তিনজন নারী ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত এই একটি উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ৭০০ জনের বেশি। দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হাবিবুর রহমান জানান, তার ৫০ শয্যার হাসপাতালে আর জায়গা নেই। রোগীদের ফ্লোরে রেখেও চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এলাকাটি পানি জমে থাকা ও আবর্জনায় ভরপুর হওয়ায় মশার প্রজননের জন্য উপযোগী হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া এখানকার অনেকে প্রতিদিন ঢাকায় অফিস করেন এবং সন্ধ্যায় ফিরে আসেন, যা সংক্রমণ বিস্তারের একটি কারণ হতে পারে বলেও ধারণা তার।
বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকাকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনাই যথেষ্ট নয়। এখন সারাদেশে এডিস মশার বিস্তার ঘটেছে এবং অনেক জেলাতেই দালানকোঠা, ভবন ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ মশার প্রজননের জন্য উপযোগী হয়ে উঠেছে। তার মতে, স্থানীয় হাসপাতালগুলো এত রোগী সামাল দিতে সক্ষম নয়। বহু হাসপাতালে আইসিইউই পর্যন্ত নেই।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাকের আশঙ্কা, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ অব্যাহত থাকবে এবং পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় আরও ভয়াবহ হতে পারে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, আগেই বরিশাল, বরগুনা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটবে বলে সতর্ক করা হয়েছিল। কারণ তিনটি উপাদান—হোস্ট (মানুষ), প্যাথোজেন (ভাইরাস) ও এনভায়রনমেন্ট (মশার উপযোগী পরিবেশ)—সবই সেখানে সক্রিয় ছিল।
কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ২০১৯ সালের মহামারির পর থেকেই এডিস মশা দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ৫৮ জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হলেও বেশিরভাগ এলাকায় কার্যকর প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগেও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অবিলম্বে জাতীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করলে এ বছর ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট