হাফিজুর শেখ যশোর
মাইকেল মধুসূদন কলেজ বা ( যশোর সরকারি এমএম কলেজে) সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলায় পড়েছে ভাটা, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কক্ষে ঝুলছে তালা। ক্যাম্পাসে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে গেলে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মঞ্চে বক্তব্য দেওয়া নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।
সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কক্ষে তালা ঝুলছে। সম্প্রতি যশোর এম এম কলেজ ক্যাম্পাসে।যে প্রাঙ্গণ একসময় হারমোনিয়াম, ডুগি-তবলা, ঢোলের বাদ্য, নৃত্য, আবৃত্তি ও নাটকের মহড়ায় মুখর থাকত; সেখানে এখন সুনসান নীরবতা। কোনো শিক্ষার্থীর আনাগোনা নেই। তিনটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কক্ষে সার্বক্ষণিক ঝুলতে থাকে তালা। মাঠে নেই খেলাধুলার চর্চা।২০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজ ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলা কার্যক্রমে এখন ভাটার টান। অথচ এ ক্যাম্পাস মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের মতো দেশের খ্যাতিমান গীতিকারের জন্ম দিয়েছে। গোটা যশোর অঞ্চলের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের প্রাণকেন্দ্র ছিল এ ক্যাম্পাস। যা এখন শুধুই ইতিহাস।সম্প্রতি ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, নতুন বিজ্ঞান ভবনের সামনে টিন শেডের তিনটি কক্ষের দরজার পাশে দেয়ালে লেখা—‘উচ্চারণ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’, ‘বিবর্তন যশোর এমএম কলেজ শাখা’ ও ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী এমএম কলেজ সংসদ’। কিন্তু তিনটি কক্ষের দরজায় তালা। উচ্চারণের কক্ষে যাওয়ার পথে ময়লার স্তূপ। দেখে মনে হলো, দীর্ঘদিন কক্ষটির পথে কারও পা পড়েনি। বিবর্তনের কক্ষে যাওয়ার পথের মধ্যে মোটরসাইকেল রাখা। কক্ষের তালায় ধরেছে জং। ভেতরে বহুদিন কারও আগমন ঘটেনি, আসবাবে ধুলার আস্তরণ দেখে সেটাই মনে হলো। তবে উদীচীর কক্ষ তুলনামূলক কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মাঝেমধ্যে কক্ষটি খোলা হয় বলে দাবি করেন এক সংগঠক।কক্ষের ছবি তুলতে দেখে উদীচী এমএম কলেজ শাখার আহ্বায়ক প্রিয় দত্ত এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির পর থেকে ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড একদম নেই বললে চলে। কলেজ কর্তৃপক্ষেরও এ বিষয়ে তেমন দৃষ্টি নেই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেমন যেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। তারপরও আমরা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড আরও গতিশীল করার বিষয়ে মনোযোগী হচ্ছি। সপ্তাহে চার দিন উদীচীর কক্ষ খোলা হয়। বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে।’বিবর্তন যশোর এমএম কলেজ শাখার সাবেক সভাপতি নূরুজ্জামান আকাশ ক্যাম্পাসে এসেছিলেন ব্যক্তিগত কাজে। তিনি বলেন, ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে ক্যাম্পাসে বাংলা বর্ষবরণ, বসন্ত ও শরৎ উৎসব, নাট্য উৎসব ও সংগঠনগুলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপনসহ বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম সারা বছর লেগে থাকত। শুধু কলেজ ক্যাম্পাস নয়, গোটা যশোর অঞ্চলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এমএম কলেজ ক্যাম্পাস পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে। সপ্তাহের ৬ দিনে ৩টি সংগঠনে কলেজের ২৫০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়মিত নাটক, নৃত্য ও গানের মহড়ায় যোগ দিতেন। ক্যাম্পাসে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার ভূমিকা ছিল সংগঠনগুলোর। কিন্তু শেষ দিকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। তিনি আরও বলেন, ২০১৭ সালে ছাত্রলীগের এক নেতা নাট্য সংগঠনের এক মেয়েকে উত্ত্যক্ত করেন। সেটার প্রতিবাদ করলে ক্যাম্পাসে তাঁকে (নূরুজ্জামানকে) বেদম পেটানো হয়। সেই থেকে মেয়েদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক আছে।সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন, ক্যাম্পাসে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে গেলে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মঞ্চে বক্তব্য দেওয়া নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। মঞ্চের আশপাশে তাঁরা প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। এতে মেয়েরা ভয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠন ও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চান না।কলেজে সহশিক্ষা কার্যক্রমে (সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলা) কর্তৃপক্ষের তেমন আগ্রহ নেই বলে অভিযোগ আছে। সারা বছর শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কোনো অনুশীলন না থাকলেও লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনে কলেজ কর্তৃপক্ষের আগ্রহ বেশি।কলেজের অধ্যক্ষ মর্জিনা আক্তার বলেন, ‘সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে কোনো সহযোগিতা চাওয়া হয়নি। করোনা পরিস্থিতিতে ছাত্রাবাস ছেড়ে যেসব শিক্ষার্থী বাড়িতে চলে গিয়েছিল, তারা এখনো শহরে ফিরে আসেনি। যে কারণে শ্রেণিকক্ষেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম। প্রতিদিন প্রতিটি বিভাগের শ্রেণিকক্ষে গিয়ে মোটিভেশনাল বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেড়েছে। এখন কলেজের সহশিক্ষা কার্যক্রমে জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি বিভাগে নিয়মিত সেমিনার আয়োজনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিতর্ক ও কুইজ প্রতিযোগিতারও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’কলেজ সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ৮ লাখ ৪০ হাজার ১৭২ টাকা ব্যয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ওই প্রতিযোগিতায় ছাত্র ও ছাত্রীদের গোলক, বর্শা, চাকতি ও হ্যামার নিক্ষেপ, সাঁতার, দৌড়–ঝাঁপসহ বিভিন্ন খেলাধুলার ইভেন্ট রাখা হয়। কিন্তু বছরে এক দিনের জন্য এসব ইভেন্টে কলেজে কোনো শিক্ষার্থী নিয়ে অনুশীলন করানো হয়নি। কলেজের ১৯ বিভাগ (সম্মান), উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক (পাস) কোর্সে ২২ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট