সন্তানহারা বাবা-মায়ের অশ্রু ঝরলো প্রধানমন্ত্রীর বুকে। তাদের কান্নায় কাঁদলেন প্রধানমন্ত্রী নিজেও।
ঢাকার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে রবিবার (৬ নভেম্বর) সকালে আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘অগ্নিসন্ত্রাসের আর্তনাদ: বিএনপি-জামাতের অগ্নিসন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খণ্ডচিত্র’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই আওয়ামী লীগ নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনায় নিহতদের পরিবার ও আহতদের সঙ্গে কথা বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। ওই সময় তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শোনেন তিনি। আক্রান্ত মানুষের আহাজারিতে কাঁদেন প্রধানমন্ত্রীও।
সাধারণ মানুষের গায়ে হাত দিলে তাদের রক্ষা নেই, হুঁশিয়ারি প্রধানমন্ত্রীর
সন্তানহারা রমজান আলী বলেন, আমি তো রাজনীতি করি না। আমি তো খেটে খাওয়া মানুষ। আমার চোখের সামনে আমার ছেলেকে আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিলো, কিন্তু আমি সন্তানকে বাঁচাতে পারলাম না। এর চেয়ে এত কষ্ট পৃথিবীতে আর নেই।
পেশায় চালক রমজান আলী। ৩৮ বছর ধরে কাভার্ডভ্যান চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। ২০১৩ সালের কোনো একদিন ঢাকা থেকে মালামাল নিয়ে রওনা হলেন গাজীপুরের পথে। সঙ্গে ১৪ বছরের ছেলে মনির হোসেন।
গাজীপুরে পৌঁছে একটি স’মিলের পাশে গাড়িটি পার্ক করে রাখেন রমজান। গাড়িতে তখন মনির ঘুমাচ্ছিলেন। বাবা রমজান ভাবলেন, ছেলেকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেই ভালো, কিন্তু অটোরিকশা ডাকার প্রস্তুতির মধ্যেই তিনি দেখেতে পেলেন, দাউদাউ করে জ্বলছে তার কাভার্ডভ্যান।
২০১৩ ও ২০১৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পেট্রলবোমার শিকার সন্তানহারা বাবা, স্বামীহারা নারীরা এভাবেই তুলে ধরেছেন নিজেদের গল্প। ওই সময় দর্শক আসনে বসে থাকা প্রধানমন্ত্রীকেও কাঁদতে দেখা যায়।
নিজ সন্তান হত্যায় যারা দায়ী ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের বিচার চাইলেন রমজান। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, আমার ছেলের মায়ের মাথায় আপনি একটু হাত বুলিয়ে দেন।
২০১৩ সালে মাদারীপুর থেকে ঢাকা আসার পথে আগুনে পুড়ে মারা যায় ১৭ বছরের কিশোর নাহিদ। তার মা রুনি বেগমও যোগ দিয়েছিলেন অনুষ্ঠানে।
তিনি বলেন, আমার সন্তানকে দেখতে পারি নাই, দেখার সুযোগ পাইনি বিএনপি জামায়াতের কারণে।
সন্তানহারা মা আর্তনাদ করে বলেন, সন্তান হত্যার বিচার পাইনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমার সন্তানের (বিচার) চাই। আপনে আমার মা, আমি আপনার সন্তান। আমার সন্তান হত্যার বিচার আপনে করবেন। আমার মায়ের কাছে অনুরোধ করতে পারি।
রাজনৈতিক সহিংসতায় মোকাবিলা কাঁচপুরে দায়িত্ব পালন করছিলেন বিজিবির সুবেদার নায়ক শাহ আলম। তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার আলেয়া জানান, ওই সময় বিএনপি-জামায়াতের একটি মিছিল যাচ্ছিলো। কোনো উসকানি ছাড়াই শাহ আলমকে সাপের মতো পিটিয়ে মারা হয়।
বুক ভরা বেদনা নিয়ে শাহ আলমের স্ত্রী নাসরিন আক্তার আলেয়া বলেন, তাকে জামাতের সন্ত্রাসীরা কাঁচপুরে কর্মরত অবস্থায় এমনভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে, যা মানুষ করতে পারে না। এরা মানুষ না জানোয়ার, কেমন সন্ত্রাসী, তা শুধু তারাই বলতে পারে।
‘যতদিন বেঁচে থাকবো এই যন্ত্রণা কখনো ভুলতে পারবো না’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে স্বামীহারা এই নারী বলেন, আমার স্বামী তো রাজনীতি করে নাই। তার তো কোনো অপরাধ ছিলো না। সে তো দেশের কাজে নিয়োজিত। তাকে কেন এভাবে হত্যা করা হলো?
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আকুতি জানিয়ে তিনি বলেন, যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে, তাদের কঠিন থেকে কঠিনতর বিচার চাই। আমি চাই আমার মতো কোনো নারী যেন এই বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের হাতে স্বামী হারিয়ে বিধবা না হয়। কোনো সন্তান যেন পিতৃহারা নয়।
ট্রাক ড্রাইভার রফিকুল ইসলাম ঢাকা থেকে মালামাল নিয়ে ছুটলেন ঠাকুরগাঁওয়ের পথে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ রফিকুল পৌঁছালেন দিনাজপুরের কাহারুল থানার ভাঁদগাওয়ে। সেখানেই চারদিক থেকে তাকে পেট্রলবোমা ছোঁড়া হয়। পুড়ে যায় রফিকুলের শরীরে। মৃত্যু গহ্বর থেকে বেঁচে ফিরলেও সারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই ক্ষত।
তিনি বলেন, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ দিতে পারি না বলেই সেদিন গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলাম।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রফিকুল। তাকে যখন তার পাশে বসা ব্যক্তি গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল, তিনি দেখতে পেলেন আগুন জ্বলছে।
রফিকুল বলেন, আল্লাহ আমাকে বাঁচাও। আমার চারটি মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। আমি মারা গেলে আমার সন্তানরা কী করে বাঁচবে? এই যে জামায়াত-বিএনপি, মির্জা ফখরুলের বাড়ির পাশে আমার বাড়ি। এত জঘন্য! উনার ড্রাইভার আমাকে বলছিলো, রফিক ভাই আপনি যাবেন না। আপনি ফিরে আসতে পারবেন না।
কাঁদতে কাঁদতে রফিকুল বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি এর কঠিন থেকে কঠিনতর বিচার চাই।
ওই সময় আন্দোলনকারীদের আঘাতে শ্রবণশক্তি হারানো সাংবাদিক আবু সাইদ তামান্না বলেন, রাজনীতি প্রতিযোগিতামূলক হবে, সুন্দর হবে, এটাই প্রত্যাশা করি। রাজনীতির নামে মানুষজনকে মেরে আহত করবে, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা এর বিচার চাই।
২০১৩ সালের ৩১ মার্চ। রাজশাহীর বোয়ালিয়ার সাহেববাজারে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন সাব ইনসপেক্টর মকবুল হোসেন। তার দিকে ছোঁড়া হলো হাতবোমা। মুহূর্তে উড়ে গেল দুটি হাত। সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত।
মকুবল বলেন, পুলিশের সদস্য হিসেবে গর্বিত। মানুষের সেবায় নিজের জীবন বিলিয়ে দিতেও কার্পণ্য করি না। আমি আহত হয়েছি, পঙ্গুত্ব বরণ করেছি, কিন্তু মনোবল হারাইনি।
এখনও কিছু জামায়াতের পক্ষের সাংবাদিকরা তার পেছনে লেগে আছে বলে অভিযোগ করেন মকবুল। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে নামে-বেনামে পুলিশ সদরদপ্তরে চিঠি পাঠানো হচ্ছে।
মকবুল আরো বলেন, আমাকে হয়রানি করছে। আমার পদোন্নতি বন্ধ করে দিয়েছে, কিন্তু আমি মনোবল হারাইনি।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট