কুমিল্লা থেকে এস এম মনি সরকারঃ
‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে/জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায়/তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।’ দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি প্রয়াত শামসুর রাহমানের এই কবিতা একাত্তর সালের এই দিনে সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছিল বাঙালির জাতীয় জীবনে।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের শৌর্য-বীর্যের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন আজ। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন, পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ভূখ-ের নাম জানান দেওয়ার দিন। রক্তনদী পেরিয়ে জন্ম নেওয়া আমাদের প্রিয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয়ের আজ ৫১ বছর পূর্তির দিন। আনন্দ-বেদনায় মিশ্র মহান বিজয় দিবস আজ।
কোনো দেনদরবার নয়, কারও দয়ার দানে নয়, সাগর-সমান রক্তের দামে বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বাধীনতা, রক্ত-সাগর পেরিয়ে বাঙালি জাতি পৌঁছেছে তার বিজয়ের সোনালি তোরণে। আর বাংলাদেশের এই মহাবিজয়ের মহানায়ক হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিজয়ের একান্ন বছর পূর্তিতে তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ।
যে কোনো দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য এই শুভক্ষণ ভাগাভাগির এক সুবর্ণ সুযোগ। যারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ও নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন- তাদের জন্য, তাদের পরিবারের জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যারা কোনো-না কোনোভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাদের জন্য এই দিনটি অসম্ভব ভালোলাগার একটি দিন।
আজ সেই বিজয়ের-গৌরবের বাঁধভাঙা আনন্দের দিন। একই সঙ্গে লাখো স্বজন হারানোর শোকে ব্যথাতুর-বিহ্বল হওয়ারও দিন। তীব্র শোষণের কুহক জাল ভেদ করে ঠিক ৫১ বছর আগে একাত্তরের এই দিনটিতে প্রভাতী সূর্যের আলোয় ঝিকমিকিয়ে উঠেছিল বাংলার শিশিরভেজা মাটি, অবসান হয়েছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সাড়ে তেইশ’ বছরের নির্বিচার শোষণ, বঞ্চনা আর নির্যাতনের কালো অধ্যায়। ৯ মাসের জঠর-যন্ত্রণা শেষে এদিন জন্ম নেয় একটি নতুন দেশ- স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। ঝড়ের ভেতরে বিকশিত অটল বৃক্ষের জীবন্ত প্রতীক স্বাধীনতা নামের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আজো প্রচ- ঝাঁকি দেয় রক্তে, শাণিত করে চেতনা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদ ও দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
বাঙালি জাতি পরাধীনতার শিকল ভেঙে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। সেই বিজয়ের ৫১ বছর পূর্তির দিন আজ। বাঙালি আঘাত খেয়েছে বারবার, কিন্তু কখনো আহত পাখির মতো আর্তনাদ করেনি, ভেঙে পড়েনি ব্যর্থতার ক্রন্দনে। সমস্ত আঘাত বুক পেতে নিয়েছে, সর্বাঙ্গে রুধির মেখে অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেই সূর্যের উদয় ঘটে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে বহু শতাব্দীর স্বপ্ন- স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে।
অবর্ণনীয় দুর্যোগে লণ্ডভণ্ড হওয়া বাংলাদেশের বঞ্চিত ও শোষিত মানুষ রুখে দাঁড়ায় সর্বশক্তি দিয়ে। আত্মবিস্মৃত বাঙালি আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে উৎসর্গ করে নিজ ও স্বজনকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ ২৪ বছরের লড়াই-সংগ্রাম এবং তার নেতৃত্বে-নির্দেশে বাঙালি জাতি এক সাগার রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে বিজয়, লাল-সবুজ পতাকা সংবলিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে।
৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ দেশে ৫১ বছর আগে আজকের এই দিনে উদয় হয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সূর্য। সেদিনের সেই সূর্যের আলোয় ছিল নতুন দিনের স্বপ্ন, যে স্বপ্ন অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল এ দেশের ৩০ লাখ মানুষ। ৫১ বছর পূর্ণ হলেও সেই স্বপ্ন এখনো পুরোপুরি বাস্তবে রূপ পায়নি, শেষ হয়নি মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কুয়াশায় জড়ানো হালকা শীতের বিকেলে রমনার রেসকোর্স ময়দানে দাম্ভিক পাকিস্তানি সেনারা যে অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে বাঙালির বুকে, হাতের সেই অস্ত্র পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের সামনে।
স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা মাঝে মধ্যেই ফণা তোলার চেষ্টা করছে। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করার ফেলার মতো ঔদ্ধত্য ও স্পর্ধা দেখাচ্ছে। তাই পাকিস্তান ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে এক অন্যরকম গণজাগরণ ও আবহে এবার বিজয় দিবস পালন করছে গোটা জাতি। এবারের বিজয় দিবস মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের মিলনস্থল বিএনপিসহ উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে আবারও পরাজিত করে রাজাকার-জঙ্গিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার দৃপ্ত শপথে বলীয়ান হচ্ছে দেশের মানুষ।
ফ্লাশব্যাক ॥ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার। এ দিন সকালে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের কর্মকর্তা জন কেলি পৌঁছান সেনানিবাসের কমান্ড বাংকারে। সেখানে নিয়াজী নেই, ফরমান আলীকে পাওয়া গেল বিবর্ণ ও বিধ্বস্ত অবস্থায়। নিচু কণ্ঠে ফরমান আলী জানান, আত্মসমর্পণ-সংক্রান্ত ভারতীয় বাহিনীর প্রস্তাব তারা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ভারতে সেই সংবাদ পাঠাতে পারছেন না। কেলি প্রস্তাব দিলেন, যদি সম্মতি থাকে তবে জাতিসংঘের বেতার সংকেত ব্যবহার করে তিনি বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন।
আত্মসমর্পণের জন্য বেঁধে দেওয়া সময় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে আরও ছয় ঘণ্টা বাড়ানো ছাড়া ভারতীয় বাহিনীর সব প্রস্তাব মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণের বার্তা পৌঁছানো হয় জাতিসংঘের বেতার সংকেত ব্যবহার করে। ভারতে তখন সকাল ৯টা ২০ মিনিট।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট