লেখকঃ মতিয়ারা মুক্তা (মাটির মা)
আমার জন্মটাই আজন্ম পাপ। আমার বড় বোন সুলেখা যেদিন জন্মে সেদিন বাড়ি সুদ্ধ হাসির পরিবর্তে চিন্তার রেশ। সবাই চেয়েছিল ছেলে অথচ হলো মেয়ে। প্রথম মেয়ে সন্তান মানেই বংশের মুখে চুনকালি এমনটা ই ভাবতো আমার বাপদাদার আমলে। তারপর জন্ম হলো আমার একটা ভাইয়ের। ভাইটাকে পেয়ে আসমানের চাঁদ উঠেছে সবার মনে। আরও ছেলের আশায় আবারো গর্ভবতী মা। মা যেন ছেলে সন্তান বানানোর একটা মেশিন মাত্র। আমার জন্ম হওয়াতে বংশের মুখে চুনকালি লেপা। জন্মের প্রথম দিন ই নাকি আমাকে অভিশপ্ত ভেবে ঘৃণা, অবজ্ঞা, অবহেলার পাত্র বানিয়ে বলা হয় এতো মেয়া দিয়া অবো কি? সত্যি কি জীবন নিয়ে জন্ম আমার। কেন যে মা শিশুকালে মেরে ফেললো না তাহলে আজ এই বয়সে এসেও আমাকে জ্বলতে হতো না। আমার নাম পুতুল পুরোনাম আবিদা সুলতানা পুতুল। তবে অনেকে মজার ছলে পুতুল বলেই ডেকে থাকে। সত্যি বলতে আমি আমাকে পুতুল মনে করেই বেঁচে আছি। বুদ্ধি হবার পর থেকেই পড়ে এসেছি মেয়ে হয়ে জন্ম নেবার কলঙ্কিত অধ্যায়। বাবা সাধারণ একজন কৃষক মা গৃহিণী কোনরকম সংসার চলে যায় আমাদের। জৈষ্ঠ্যমাস আম কাঁঠালের দাওয়াত খেতে আমরা নানাবাড়ি যাই। বড়ো বোন সুলেখা আমি বাড়ির সব বাচ্চারা খেলাধুলায় মত্ত। মা ডাকছে খেতে আমরা সবাই সেখানে খেতে গেলেও ভাইটা আসেনি। মা প্রশ্ন করতেই আমাদের সাথে নেই জানালাম।চারদিক খুঁজে না পেয়ে একজনের তথ্য মতে পুকুরে খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। বড় মামা ভাইকে কোলে নিয়ে উঠে এলো কিন্তু ভাইটা আর পৃথিবীতে নেই। মায়ের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হতে লাগলো। গ্রামের সবার চোখে অঝরে অশ্রু ঝরছিল আমি তখন বয়সে ছোট হলেও সবার কষ্ট বুঝতে পাচ্ছিলাম। বাবাকে খবর দেয়া হলো এই বলে যে ভাইটা এক্সিডেন্ট করেছে। সাইকেল করে বাবা আসতে আসতে জানতে চায় কি হয়েছে? ভাইয়ের লাশটা দেখে বাবার মাথায় রক্ত উঠে যায়।লাশটা বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। পুরুষ মানুষ খুব কম ই কাঁদে এভাবে। বাবার মনে ক্ষোভ ছিল সে বলে যাচ্ছিল মা ইচ্ছে করেই তার ছেলেকে নাইওর এনে মেরে ফেলেছে। সেই থেকে আমাদের দুই বোন আর মায়ের উপর নেমে আসে পাশবিক নির্যাতনের শিকল। নিত্যদিন মাকে লাঠি দিয়ে মারা হতো আর আমি দড়জার পেছনে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। কখনো কখনো মনে হতো এক্ষুণি বাবাকে নিজের হাতে খুন করে জেলে যাই। ক’দিন বা সহ্য করা যায় এসব কষ্ট! বড়বোন সুলেখার বিয়ের পর আমার দিকে নজর। আমার বয়স তখন দশবছর বিয়ের জন্য ছেলেও ঠিক করা হয়েছে। আমাদের বাড়িতে দিনমজুর কাজ করে আবুল ফজল বয়স ২৭। বিয়ে সংসার এসব কিছু বুঝে আসেনি আমার মধ্যে তবে মনে মনে বড় হবার ভীষণ জেদ পুষতাম। মেয়ে হলে বংশের মুখে চুনকালি এই শব্দগুলো আমাকে খুব কষ্ট দিতো। তাই চাইতাম পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হতে বাবার এই ভুল ধারণা পাল্টে দিতে৷ কিন্তু মেয়েদের পড়াশোনা করে কি লাভ? কি করতে পারবে? তাই বন্ধ করে দেয়া হয় স্কুল।
(চলবে)
গল্পটি বাস্তব জীবনের এক অবহেলিত নারীকে নিয়ে
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট